হিমালয়ের সঙ্গে পামির পর্বতমালার যে পার্থক্যটা ভোগাল
পর্বতারোহণের মর্যাদাপূর্ণ একটি অভিযান ‘স্নো লেপার্ড চ্যালেঞ্জ’। এই অভিযান সম্পন্ন করতে তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানে অবস্থিত পামির ও তিয়েন শান পর্বতশ্রেণির পাঁচটি সাত হাজার মিটারের শৃঙ্গে আরোহণ করতে হয়। রোমাঞ্চকর অভিযানটি শুরু করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী সালেহীন আরশাদী ও ইমরান খান। তিন পর্বের এই অভিযানে প্রথম পর্বে অভিযাত্রীরা গেছেন কিরগিজস্তানের লেনিন শৃঙ্গ আরোহণে। সেখান থেকেই প্রথম আলো অনলাইনের জন্য নিয়মিত লিখছেন সালেহীন আরশাদী। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব
পিক লেনিন বেজক্যাম্পে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন।
আজ একটু বেশি ঘুমাব বলে সকাল আটটার অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। কিন্তু ভোর থেকেই বেজক্যাম্পে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে গেছে। যে আরোহীরা ওপরের দিকে যাবেন, তাঁদের মালামাল ওজন করা হচ্ছে। বেজক্যাম্প থেকে ক্যাম্প ১ পর্যন্ত মালামাল ঘোড়ার পিঠে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ জন্য কেজিপ্রতি ৩ ডলার লাগে। ঘোড়াগুলো দেখতে সুন্দর, হৃষ্টপুষ্ট ও চকচকে। কিরগিজ পাহাড়ের ঘোড়া বলে কথা। ঘোড়াগুলোর গলায় বাঁধা ঘণ্টি টুনটুন করে ভোরেই ঘুম ভাঙিয়ে দিল। তবু জেদ করে স্লিপিং ব্যাগে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সেই আটটা। হাত-মুখ ধুয়ে, ফ্রেশ হয়ে নাশতা করতে করতে সাড়ে নয়টা।
আজকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল বেজক্যাম্পের পাশেই একটি চূড়ায় অ্যাক্লিম্যাটাইজেশন (উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো) করব। বেজক্যাম্পের উচ্চতা প্রায় ৩ হাজার ৬০০ মিটার। ক্যাম্প ১-এর উচ্চতা প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিটার। হুট করে ক্যাম্প ১-এ গিয়ে যেন অসুস্থ বোধ না করি, তাই উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। যেহেতু বেজক্যাম্প থেকে পেট্রোভক্সি চূড়াটি কাছেই আর উচ্চতাও প্রায় ৪ হাজার ৮০০ মিটার, ক্যাম্প ১ থেকে কিঞ্চিৎ বেশি, তাই এই চূড়াতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
নাশতা শেষ করে প্রচুর পানি ও হালকা কিছু খাবার ডে-প্যাকে নিয়ে আমরা ট্রেক শুরু করলাম। রওনা দেওয়ার পর বুঝতে পারি, পেট্রোভক্সি চূড়ায় যাওয়ার পথ অনেকটা ঘুরে গেছে। আমাদের পুরো নিচ থেকে ধীরে ধীরে রিজলাইনে উঠতে হবে। আমরা খুব ধীরগতিতে এগোতে লাগলাম। আস্তে আস্তে রিজলাইনের ওপরে উঠে থেকে পামিরের পুরো ভূপ্রকৃতি আমাদের সামনে উন্মোচন হতে লাগল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম পামিরের ঢেউখেলানো ভূমি ও তাতে একটু পরপর ছোট-বড় পান্না সবুজ হ্রদ। অনেক ওপর থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাদা রঙের কিরগিজ যাযাবরদের তাঁবুও দেখতে পেলাম। স্থানীয়দের এই অস্থায়ী আবাসগুলোকে বলে ইয়র্ট। যাযাবরেরা তাদের গৃহপালিত পশুগুলো নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এই ইয়র্টগুলো নিয়েই যায়। এই অস্থায়ী ঘরের প্রতিটি অংশ খুলে ফেলা যায়। বাঁশ ও তেরপল দিয়ে এগুলো বানানো হয়। ভেতরটা অসম্ভব গরম থাকে। বাইরের দিকটা সাদা হলেও ভেতরে রঙিন কার্পেট বা শতরঞ্জি ব্যবহার করে।
রিজলাইন ধরে উঠতে উঠতে আমরা বুনো ফুলের রাজ্যে চলে এলাম। নীল, সাদা, হলুদ, রংবেরঙের ফুল দিয়ে পুরো পর্বতটি ছেয়ে আছে। এই ফুলগুলোর ওপর উড়ে উড়ে বসছে মৌমাছি, প্রজাপতি ও ভ্রমর। পথজুড়েই এই দৃশ্য। সবুজ পর্বতের ঢালের পেছনে থেকে উঁকি দিচ্ছে লেনিন পিকের প্রতিবেশী চূড়াগুলো।
আমরা রিজলাইনের ওপর বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে থাকা উটের কুঁজের মতো ছোট পাহাড় একের পর এক অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনের একটি পাহাড়ে আরোহণ করার পরের মুহূর্তেই দেখি পথ আবার নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে ট্রেক করতে আমাদের অনেক সময় লেগে যাচ্ছিল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড গরম ও ঝোড়ো হাওয়া। হিমালয়ের সঙ্গে পামিরের পর্বতে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পার্থক্য লাগল। হিমালয়ে সব সময় এত বাতাস থাকে না। কিন্তু পামিরে সর্বক্ষণ বাতাস বইতে থাকে।
রিজলাইন অতিক্রম করতে করতে বেলা তিনটার দিকে আমরা ৪ হাজার ৬৬৩ মিটার উচ্চতায় চলে আসি। পেট্রোভক্সি আমাদের থেকে তখন মাত্র ১৫০ মিটার উঁচুতে ছিল। কিন্তু আমাদের হতাশ করে দিয়ে এবারও রিজলাইনটি এখানে এসে একেবারে ভেঙে গেছে। সংযোগ রিজ খুঁজতে গিয়ে আমরা পেট্রোভক্সির মোরেন বা গ্রাবরেখার (মাটি ও প্রস্তর দ্বারা গঠিত তীর) কাছে চলে আসি। প্রচণ্ড গরমে গ্রাবরেখার নিচে থাকা বরফ তখন গলতে শুরু করেছে। হিমবাহ গলাপানির সঙ্গে মাটি ও পাথর মিলে পুরো গ্রাবরেখাই কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে আছে। সেই সঙ্গে এদিক-সেদিক দিয়ে শিলাধস হচ্ছে। রিজলাইন ধরতে হলে আমাদের এই গ্রাবরেখা অতিক্রম করতে হবে। অল্প কিছু দূর আমরা চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু অনেক ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় আমরা পিছু হটি।
অ্যাক্লিম্যাটাইজেশন দিক থেকে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় যেতে পেরেছি। কিন্তু একই সঙ্গে চূড়াটির এত কাছ থেকে ফিরে আসার ব্যাপারটি আমাদের হজম হচ্ছিল না। ঠিক ওই মুহূর্তে ঝুঁকি না নিয়ে ফেরত চলে আসার সিদ্ধান্তটি নেওয়ায় দুজনেই খুশি ছিলাম, কিন্তু এটাও জানতাম যে ভুলটি পুরোপুরি আমাদের ছিল।
ফেরার পথজুড়ে আমরা আমাদের এই ক্লাইম্বটি পোস্টমর্টেম করছি। প্রথমত, আমাদের ভুল ছিল চূড়াটিকে আমরা খুবই অবহেলা করেছি। ধরেই নিয়েছিলাম উচ্চতা কম বলে ক্লাইম্বটি খুব সহজ হবে। এই চিন্তা করেই হেলেদুলে সকাল সাড়ে নয়টায় আমরা ট্রেক শুরু করেছিলাম। গ্রাবরেখার কাছে যখন পৌঁছেছি তখন ভরদুপুর। প্রচণ্ড গরমে বরফ তখন গলতে শুরু করেছে। আমাদের উচিত ছিল অন্যান্য চূড়ার মতোই খুব ভোরে যাত্রা শুরু করা। সে ক্ষেত্রে খুব সহজেই গরম বেড়ে যাওয়ার আগেই গ্রাবরেখা অতিক্রম করে স্নো লাইনে চলে যেতে পারতাম।
পামিরের ছোট চূড়াটি আবারও আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। এখন থেকে কোনোভাবেই আর খাপছাড়া চিন্তা করা যাবে না। প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তাভাবনা করে নিতে হবে। আগামীকাল আমরা বেজক্যাম্পে থেকে ক্যাম্প ১-এর পথে রওনা হব।
৩ আগস্ট ২০২৩