হিমালয় অভিযানের যে কষ্ট ও আনন্দ অন্যদের বোঝানো যায় না
নেপালের পোখারা থেকে অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প—সব মিলিয়ে ১০ দিনের ট্রেক। পথটা দুর্গম, তবে অপার্থিব সৌন্দর্যে ভরা। হিমালয়ের প্রকৃতির এই সৌন্দর্য ভুলিয়ে রাখে গন্তব্যে পৌঁছার কষ্ট। যেতে যেতে আরও কত কি যে চাক্ষুষ হয়! মে মাসে পার্বত্য এই পথেই হেঁটে এসেছেন ইফতেখারুল ইসলাম। সেই অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। আজ পড়ুন অষ্টম পর্ব
ক্যাম্পে ফিরে সবকিছু গুছিয়ে নিতে সময় লাগে না। প্রাতঃকৃত্য সেরে ছয়টার দিকে ব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক নিয়ে আমি তৈরি। গাইড তেজকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে এত ভোরে ব্রেকফাস্ট না করে আমরা কি এখনই বের হয়ে যেতে পারি না? তেজ বলল, এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। এখান থেকে হেঁটে দেড় ঘণ্টায় মচ্ছপুছারে বেজক্যাম্প পৌঁছে যাব। সেখানে ব্রেকফাস্ট করা যাবে। এখান থেকে আজ যাঁরা ফিরতি ট্রেক শুরু করছেন, তাঁদের প্রায় সবাই দোভান অথবা ব্যাম্বুতে রাত যাপন করবেন। আমরা যদি এখন রওনা হয়ে স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে পারি, তাহলে আরও একটু এগিয়ে সম্ভব হলে একেবারে লোয়ার সিনুওয়া গিয়ে দিন শেষ করব। তার পরের দিন হবে তুলনামূলকভাবে ছোট ট্রেক। তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছে যাব ঝিনু। সেখানে আছে উষ্ণ জলের ধারা। চারপাশে অপরূপ সবুজ পাহাড়।
ঝিনু তো পরের দিনের লক্ষ্য, তা নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। এখন অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ফেরত যাত্রা শুরু করি। গতকাল সন্ধ্যার তুষারপাতের ফলে চারদিক ঝকঝকে সাদা। তার ওপর ভোরের ঝলমলে রোদ পড়ে রীতিমতো চোখধাঁধানো শুভ্রতা। সকাল সোয়া ছয়টাতেই চারদিক এমন প্রখরভাবে রৌদ্রোজ্জ্বল হতে পারে, আমার জানা ছিল না। গতকাল সকাল থেকে যে সানগ্লাস পরেছি, আজ ভোরেই আবার তা পরে নিই। মাঝেমধ্যে আমার চশমার দরকার হয়, অথচ সানগ্লাসটা খুলতে পারি না। পর্বতের এই উচ্চতায়, এ রকম তুষারের দেশে হাঁটতে হলে পোলারাইজড লেন্সযুক্ত তৃতীয় বা চতুর্থ ক্যাটাগরির সানগ্লাস পরে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এই সানগ্লাস মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ আলো ভেতরে ঢুকতে দেয়।
এখান থেকে এক দিনে ট্রেক করে লোয়ার সিনুওয়া পর্যন্ত পৌঁছানো যে খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য ও সাহসী সিদ্ধান্ত, সেটা কিছুক্ষণ হাঁটার পরই বুঝতে পেরেছি। পার্বত্য পথে নেমে আসাটা সব সময় সহজ হয় না। নামার সময়েও অনেক জায়গাতেই চড়াই ধরে উঠতে হয়। আর উতরাই ধরে পাথরের ওপর দিয়ে নামার সময় পায়ের সামনের দিকে, বিশেষ করে দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে যে চাপ পড়ে, সেটা একসময় খুব খারাপ ক্লিনিক্যাল রূপ নিতে পারে।
আমি এমনিতেই ধীরে হাঁটি। পায়ের আঙুলে সেই ব্যথা দুঃসহ হয়ে উঠলে আমার হাঁটার গতি খুবই শ্লথ হয়ে পড়ে। আগেও ট্রেক শেষে আমার পায়ের নখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবারও একই অবস্থা। কেন এত ধীরে হাঁটছি, তেজ তা বুঝতে পারে না। আমার সঙ্গে এলে ও কখনোই স্বাভাবিক গতিতে হাঁটতে পারে না। তাই ওর জন্য আমার একটু খারাপ লাগে। লাঞ্চের সময় কিছুই খেতে ভালো লাগে না আজ। কিন্তু যথেষ্ট না খেলে এত দীর্ঘ পথ হেঁটে যাব কীভাবে? একটু পরে ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে সবাই মিলে প্রোটিন বার ও খেজুর খাই।
দুপুরের বিরতির পর বুট ও মোজা খুলে দুই পায়ের বুড়ো আঙুলে মুভ স্প্রে লাগলাম। এতে ব্যথা সামান্য কমল। সেটা খুবই অস্থায়ী। তবু সাময়িক উপশম হলো বলে আরও কিছুক্ষণ হাঁটতে পারি। তারপর ব্যথাটা ফিরে আসে। হাঁটার সময় কষ্ট হচ্ছে, তবে পায়ের বিশেষ করে আঙুলের কতটা ক্ষতি হয়েছে, আমি নিজেও তা বুঝতে পারিনি।
বিকেলের দিকেই বোঝা গেল সন্ধ্যার আগে কিছুতেই লোয়ার সিনুওয়া পৌঁছাতে পারব না। সন্ধ্যার অন্ধকারে যে পথটুকু পাড়ি দিতে হবে, সেটাই আবার আজকের দিনের সবচেয়ে দুঃসাধ্য অংশ। এক ঘণ্টার সবচেয়ে খাড়া চড়াই আর আধা ঘণ্টার খাড়া উতরাই। শেষ দিকে লক্ষ করলাম, উঁচুতে উঠতে কষ্ট কম হচ্ছে। নামতে গেলে কষ্ট হচ্ছে বেশি। সামনের দিকে পা ফেলার সময় আঙুলের ব্যথায় কষ্ট হচ্ছে বলে শেষ দিকে আমি পাশ ফিরে এক পা এক পা করে নিচে নামি। তেজ কিছু দূর গিয়ে গিয়ে আমার জন্য দাঁড়ায়।
এমনিতেই জনপদ থেকে দূরে দুর্গম পার্বত্য পথে নির্জন নীরবতার মধ্যে নিজের সঙ্গে নতুন করে দেখা হয়; নানা রকম ভাবনা গুঞ্জরিত হতে থাকে মনের মধ্যে। এখানে সারা দিন একা একা হাঁটার সময় কত রকম চিন্তা যে মনে আসে, কোনো দিন তা কাউকে বলা হবে না। দুপুর পর্যন্ত পথে অনেক ট্রেকারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। হাই, হ্যালো, নমস্তে—এ রকম সম্ভাষণ বিনিময় হয়। দুপুরের পর থেকে ট্রেকিংয়ের পথ হয়েছে জনবিরল। এত বড় পাহাড়ের পটভূমিতে, প্রশান্ত নীরবতার মধ্যে আমি একদম একা।
পর্বতশিখর, কিছু অপূর্ণ স্বপ্ন ও অচেনা তৃষ্ণা আমাকে টানে। লক্ষ্যে পৌঁছোনোর পর অসাধারণ সব স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসি। এমনিতেই খুব দ্রুত হাঁটতে পারি না। তার ওপর পায়ের তীব্র ব্যথা ও অতি মন্থর গতির জন্য মন একটু খারাপ হয়। সদ্য অন্নপূর্ণা দেখে আসার স্মৃতি দিয়ে সেই বিষাদ দূর করতে চেষ্টা করি। এখন যতই কষ্ট হোক, হিমালয়ের আরেকটি সুন্দরতম গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি, অপরূপ অন্নপূর্ণা দেখে এসেছি। মনজুড়ে একটা প্রশান্তি।
গতকাল থেকে একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছিল। হিমালয়ের এই দুর্গম পথে-প্রান্তরে, অরণ্যে, পাথরে ও তুষারে হেঁটে চলার কষ্ট ও আনন্দ কিছুতেই অন্যদের বোঝানো যায় না। দৃশ্যকে শব্দ দিয়ে আঁকা কঠিন। তাহলে হিমালয়ে ট্রেক করে চলার এই গল্প, রোদে উজ্জ্বল আকাশ ও পর্বতশিখরের বর্ণনা, বৃষ্টি ও রংধনুর সৌন্দর্যের কথা বারবার লিখে কী হবে। তা ছাড়া এ কাহিনিতে জয়–গৌরবের কী আছে? আমার মনে হয় না আমি এখানে কোনো কিছু জয় করতে আসি। মানুষ বা প্রকৃতি, কাউকেই আমি জয় করতে জানি না। নিজেকে বা নিজের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি শুধু। হিমালয়ের প্রকৃতি আমাকে বিস্মিত ও মোহাবিষ্ট করে।
আবার এই অনন্য অভিযানের গল্প না-ই যদি লিখি, তাহলে যে হিমালয়কে আমি দেখছি বা অনুভব করছি, তার অংশ অন্যদের কীভাবে দিতে পারব? আমরা যারা একটুও লেখালিখি করি, তাদের সবারই কি কিছু অঙ্গীকার থাকে না? যেমন লিখতে চাই, তেমন ভালো লিখতে না পারলেও যা কিছু দেখেছি, তা অন্যদের জানাতে ইচ্ছে করে।
এখানে হেঁটে চলার সময় প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক অনেক গান ও কবিতার লাইন মনে পড়ে। গতকাল থেকে বারবার মনে পড়ছিল শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বইয়ের উত্সর্গপত্রটির কথা। হিমালয়ের আরও গল্প লিখব কি না, এ ভাবনার মধ্যেও হাঁটতে হাঁটতে কেন যেন বারবার ওই কয়েকটি লাইন উচ্চারণ করি, ‘আমার খামার নেই/ নেই কোনো শস্যকণা/ আছে শুধু একটি আকাশ/ তারই কিছু আলো-নীল/ আজো হে সুদুরতমা/ ভালোবেসে তোমাকে দিলাম।’