তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল
সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন একাদশ পর্ব
প্রথম অপারেশন শেষ করে ক্ষুধায় পাগলপ্রায় দশা। রিসেপশন থেকে ঘোষণা এল, দুপুরের খাবার টেবিলে দেওয়া হয়েছে। মনে হলো ঢোলে বাড়ি পড়ল। হুমড়ি খেয়ে সবাই জাহাজের রেস্তোরাঁর দিকে ছুটল। মাত্র খেতে শুরু করেছি, তখনই রিসেপশন থেকে ঘোষণা, খাওয়ার পরপরই শুরু হবে দ্বিতীয় অপারেশন, সেটি জোডিয়াক অপারেশন।
জোডিয়াক বুঝি; কিন্তু জোডিয়াক অপারেশন বুঝতে পারলাম না। হাতে সময় কম। খাবারের টেবিলে আজ বেশি কথা হচ্ছে। আশপাশে বেশ উচ্চ স্বরে কথাবার্তা চলছে। সবার চেহারায় বাহাদুরি ভাব। আমাদের উল্টো দিকের বড় টেবিলটায় ১২ জন বসেছেন, ১১ জন নারী আর ১ জন পুরুষ। পুরুষটি এমনিতে একেবারেই চুপচাপ থাকেন। আজ তিনিও বেশ সরব। কেউ কেউ ভীষণ তর্ক করছেন, কেউ সে তর্কের জবাব দিতে ব্যস্ত। সবার মুখে প্রথম অপারেশনের গল্প। জাহাজজুড়েই যে আনন্দের বন্যা বইছে, খাবারের টেবিলগুলোতেই তা স্পষ্ট।
আজও আমরা চার নারী এক টেবিলে বসেছি। প্রতিদিন আমাদের একই টেবিলে বসানোর ব্যবস্থা করছে আমাদের প্রিয় ক্রু সুহার্তো। খাওয়ার পর্ব শেষে হঠাৎ ক্রুর কাছে ক্যারোলিন জানতে চাইল, জাহাজে ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মদিন উদ্যাপন করা যাবে কি না? সুহার্তো দ্রুত উত্তর দিল—জাহাজে ২২ তারিখে কোনো জন্মদিন উদ্যাপন করা হয় না, হয় ২১ তারিখে, নয়তো ২৩। তার রসিকতায় আমরা আরেক দফা হেসে রেস্তোরাঁ ত্যাগ করলাম।
জাহাজ থেকে নামব বলে কার্ড পাঞ্চ করেছি। আমার দিকে তাকিয়ে আছে উৎসুক দুই চোখ। জিমি সাহেব। উন্নত নাসিকা, মাথায় কোঁকড়া চুল, মুখে কূটনীতিকের হাসি। জোডিয়াক অপারেশন ব্যাপারটা কী বলেন তো, তাঁর কাছে জানতে চাইলাম। দেখে মনে হয়, সহাস্যে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য নিজেকে সদা প্রস্তুত রাখেন তিনি। বিগত যৌবনা জিমি উত্তর দিলেন, জাহাজের সব জোডিয়াক যাবে প্যারাডাইস উপসাগরে, ঘণ্টা দুয়েক আমরা জোডিয়াকে চড়ে উপসাগরে ঘুরে ঘুরে তিমি দেখব, জোডিয়াক থেকে নামাবে না, এটাই জোডিয়াক অপারেশন। তাঁর কথায় আমি সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়লাম। এ অপারেশনের মূল আকর্ষণ তিমি দেখা! একটু দমেও গেলাম। বিস্ময়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবার ভয়। আমি তো সাঁতার জানি না!
জোডিয়াক চলতে শুরু করেছে। এক জোডিয়াকে আমরা ১০ অভিযাত্রী। আমাদের গাইড সেরেনাই জোডিয়াকের চালক। মোটরের শব্দ তুলে জোডিয়াক চলছে। ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে তিরের মতো বিঁধছে। আকাশ গুমোট।
এ এক দুঃসাহসী অভিযাত্রা। তিমি পানিতে ডুবে থাকে। মাঝেমধ্যে কারও কারও ইচ্ছা হলে ওপরে ওঠে, তখনই সেগুলোর দেখা মেলে। আমরা সবাই প্রায় জানি, তিমি মাছ নয়। মাছের শ্বাস নেওয়ার জন্য ফুলকা থাকে, তিমির থাকে ফুসফুস। স্তন্যপায়ী তিমির শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেনের দরকার পড়ে। তখন পানির ওপর ভেসে ওঠে। এই সুযোগে আমরা সেগুলোর দেখা পাই। তিমি দেখতে আমাদের এই জোডিয়াক অপারেশন।
জোডিয়াক চলছে। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। সবার মুখ মলিন। সবাই কি আমার মতো ভীত! আমি আমার পাশের জনের গা ঘেঁষে বসি, তাতে ঠান্ডার প্রকোপ কমে। হঠাৎ জোডিয়াক থামিয়ে দেয় সেরেনা। বিপুল জলরাশির এক দিকে সেরেনার দৃষ্টি চলে যায়, আমরাও সেদিকে তাকাই। কালো দীর্ঘ লম্বা একটা কিছু পানির ওপর ভেসে উঠছে। আতঙ্কে কাঠ হয়ে যাই। সবাই বলে ওঠে, হোয়েলস ওভার দেয়ার। হঠাৎ ফুস করে একটি শব্দ হলো। এমন শব্দ আগে শুনিনি। তিমি পানির ওপর ভেসে উঠেছে, তিমি নিশ্বাস নিচ্ছে। সে তার শরীরের চারদিকে ঝরনার মতো পানি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ফেলছে। এটাই তার জলকেলি।
তিমির এই জল-ক্রীড়া দেখে আমরা সবাই অস্থির এবং ভীত। ডুব দেওয়ার সময় সে তা দেখিয়ে তবেই বিদায় নেয়। এটাই তার যাওয়ার নিয়ম। মনে হলো লেজ তো নয় যেন আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাল। সবার হাতে ক্যামেরা। ঠিকঠাক ক্যামেরা তাক করার আগেই সে ডুবে গেল!
সেরেনা আমাদের অভয় দিল। তিমি দানবাকৃতির প্রাণী হলেও তাণ্ডব চালায় না। সেরেনা বলছে, সে এক দশকের মতো অ্যান্টার্কটিকায় আসছে; কিন্তু তিমিকে তাণ্ডব চালাতে দেখেনি। সেরেনার কথায় ভরসা পাচ্ছি না। সারা জীবন তো শুনেছি তিমির জাহাজ উল্টে দেওয়ার কাহিনি। অ্যাডভেঞ্চার মুভিগুলোতে তো তা–ই দেখানো হয়। সাগরের দানো হিসেবেই তিমিকে আমরা দেখেছি। ভয় কমে না। ডুব দিয়ে সে আরও কাছে এসে যদি জোডিয়াক উল্টে দেয়? শীতে হাত-পা এমনিতেই ঠান্ডা, ভয়েও আরও ঠান্ডা হয়ে যায়। আশপাশের কাউকে অবশ্য বুঝতে দিই না। পানির দিকে তাকালেই ভয় বাড়ে। সেরেনা আবার মোটর চালু করে, জোডিয়াক চলতে শুরু করে।
তিমিকে ঘুমাতে হয়। তবে তা টানা বেশিক্ষণের সুখনিদ্রা নয়। কারণ, শ্বাস নেওয়ার জন্য কিছু সময় পরপর তাদের পানির ওপর উঠতে হয়। বলা হয়ে থাকে, তিমি এক চোখ খোলা রেখে ঘুমায়। ধারণা করা হয়, তিমির মস্তিষ্কের অংশ দুটি পালাক্রমে ঘুমায়। তাই এক চোখ খোলা রেখে ঘুমাতে পারে তিমি। কখনো এরা পুরোপুরি ঘুমন্ত থাকে না। চাহিদা অনুযায়ী বিশ্রাম নেয়। তিমি একে ওপরের সঙ্গে একধরনের সুরেলা শব্দ করে যোগাযোগ করে। বিজ্ঞানীরা এর নাম রেখেছে তিমির গান। বলা হয়ে থাকে, তিমির গান মৃদু গুঞ্জনের মতো।
বৃহৎ হিমশৈলের ফাটলের মধ্য দিয়ে জোডিয়াক ছুটছে। ফাটল পেরিয়ে আরও বৃহৎ জলরাশির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আবারও জোডিয়াকের ইঞ্জিন বন্ধ হলো। এর অর্থ আমরা বুঝে ফেলেছি। তিমি আমাদের সন্নিকটে। নিস্তব্ধ চারদিক। তিন দিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে তিনটি তিমি। আমাদের জোডিয়াক আর চলতে পারছে না।
আরও পড়ুন
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়
৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম