হিমালয়ে হিমবাহে ৯
মেঘ পাহাড়ের লুকোচুরি
৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রার নবম পর্ব পড়ুন আজ।
গোকিও রির চূড়াই ছিল এবারের অভিযানে আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তাই গোকিও রির শীর্ষে আরও কিছু সময় কাটাতে ইচ্ছে করে। শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে এসেছি। পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার সময় মাঝেমধ্যে শুধু পানি খেয়েছি। এতক্ষণ লক্ষ্যে পৌঁছানোর উত্তেজনা ও একাগ্রতায় অন্য কোনো দিকে মন দিতে পারিনি। এমন কোনো উঁচু পর্বতশিখর এটা নয়, তবু শীর্ষে পৌঁছানোর পর প্রথমে খুব আনন্দ হয়, নিচে-ওপরে ও চারদিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য ও পরাবাস্তব দৃশ্যগুলো দেখি। ছবিতে তার কিছুই ধরা পড়ে না। সব মিলিয়ে খানিকটা অভিভূত সময় কাটে। সকাল আটটায় বেশ খিদে পেয়ে যায়। রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দিয়ে সাজানো পর্বত শীর্ষ থেকে একটু পেছনে গিয়ে একটা বড় পাথরের ওপর বসি। ৫ হাজার ৩৫৭ মিটার বা ১৭ হাজার ৫৮৫ ফুট উচ্চতায় আরাম করে বসে আমার ব্যাকপ্যাক থেকে প্রোটিনবার আর খেজুর বের করে তেজ আর আমি নাশতা করি।
শীর্ষে উঠে আসা বেশ কজন নারী ও পুরুষ এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এত ঠান্ডাতেও ভারী জ্যাকেট খুলে ফেলেছেন কেউ কেউ। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট মানুষ—এখনো উঠে আসছেন। যাঁরা উঁচুতে উঠে এসেছেন, তাঁদেরও খুব ছোট দেখায়। বিশালতার পটভূমিতে দাঁড়ালে হয়তো এমনই হয়।
আকাশ কতক্ষণ মেঘমুক্ত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আর একবার প্রাণভরে দেখি পর্বত শিখরগুলোকে। এখান থেকে যাদের দেখা যায়, তাদের মধ্যে চারটির নাম পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরের তালিকায় রয়েছে। সর্বোচ্চ ছয়টি শিখরের মধ্যে দ্বিতীয় কে-টু পাকিস্তানে আর তৃতীয় কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতে। বাকি চারটিই নেপালে—তাদের সব কটিকে এখান থেকে দেখা যায়। সর্বোচ্চ শিখর এভারেস্ট, চতুর্থ লোৎসে, পঞ্চম মাকালু আর ষষ্ঠ সর্বোচ্চ শিখর চো ওইয়ু। এ ছাড়া আছে পুমোরি, তাবুচে, চোলাতসে ও থামশের্কু। ওই সব শিখরের নিচে আরও অনেক ছোট পাহাড় আর তার নিচে দেখা যায় বিস্তীর্ণ অন্তহীন গোজাম্পা গ্লেসিয়ার। সবচেয়ে নিচে গোকিও লেক। হিমালয়ের সব বিখ্যাত পর্বতশিখরকে প্রহরীর মতো ঘিরে রেখেছে গোজাম্পা হিমবাহ।
আগের দিন ট্রেক করে আসার সময় একটা লেক থেকে অন্য লেক অনেক দূরে মনে হয়েছিল। গোকিও রি পাহাড়ের ওপর থেকে দেখে মনে হয় গোকিওর তিনটি লেক পরপর সাজানো, একে অপরের সঙ্গে প্রায় যুক্ত হয়ে আছে।
ওই পর্বতশিখর আর হিমবাহের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার সময় তেজ আমার মোবাইলে কয়েকটি ছবি তুলে দেয়। মোবাইল হাতে নিয়ে নিজের ছবি দেখে হতবাক হয়ে যাই। চশমাতে পুরো হিমালয়! শিহরিত বোধ করি আমার রোদচশমার কাচে তুষার ঢাকা পর্বতশিখরের প্রতিফলন দেখে। ছেলেবেলায় পড়া ভ্রমণকাহিনিতে অস্পষ্ট কয়েকটি ছবি দেখেই কী রকম মোহিত হতাম। এখন আমার মতো অনেকেরই মোবাইল ও ল্যাপটপ ভরে আছে হিমালয়ের তুষারঢাকা পর্বতশিখরের ছবিতে।
নেমে যাওয়ার পালা
এবার নেমে যাওয়ার পালা। নিচে নামা তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু হাঁটতে শুরু করলেই আমি অক্সিজেনের অভাব টের পাই, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। পরিশ্রান্ত ও ধীর পায়ে গোকিও রি থেকে নেমে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। অপরূপ দৃশ্য বারবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। অসামান্য সার্থকতার অনুভূতি জুড়ে থাকে আমার পুরো মন। যতই পরিশ্রান্ত লাগুক, চারদিক ভালোভাবে দেখে নিই, একটু পরে বিশ্রাম তো পাবই।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের উজ্জ্বল নীল আভা ম্লান হতে শুরু করে, ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ। সেই মেঘ ঢেকে দেয় প্রিয় পর্বতশিখরগুলোকে। ছোট ছোট মেঘ। বাতাসে মেঘ সরে গেলে আবার নীল আকাশ দেখা যায়, পর্বতশিখর দেখা যায়। মেঘ আর পর্বতশিখরের এই লুকোচুরি খেলা দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় মেঘলা দিনে মাঝেমধ্যে হয়তো পাহাড়েরা লুকিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। কিন্তু ছোট ছোট মেঘ এত বড় পাহাড়ের সঙ্গে ঠিক পেরে ওঠে না। তাই মেঘেরা সঙ্গী ডেকে আনে। কিছুদূর নেমে আসার পর দেখি আরও অনেক মেঘ এসে জমা হয়েছে। সব মেঘ মিলেমিশে বড় হয়, ঢেকে দেয় বিস্তীর্ণ পর্বতমালা। আজ সকালে সত্যিই আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল। সময়মতো শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। সূর্যোদয়ের পরও অনেকটা সময় মেঘমুক্ত ছিল আকাশ। সে কারণেই দেখা হয়েছে এই অপূর্ব অপার্থিব দৃশ্য।
ফেরার পথেও কেউ কেউ আমাকে ছাড়িয়ে দ্রুত নিচে নেমে যায়। আমার তাড়া নেই। সাবধানে ধীরে ধীরে নামছি। অনেকখানি নেমে আসার পর দেখি তখনো ওপরের দিকে উঠছেন কিছু মানুষ। জোহরা ও শিবা এত বেলা করে ওপরে আসছে দেখে একটু খারাপ লাগে। কাছাকাছি এসে ওরা জিজ্ঞেস করে, ওপর থেকে কেমন দেখা গিয়েছিল, আর এই পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছাতে এখন ওদের কত সময় লাগবে। তেজ ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। ওদের নিরুৎসাহিত করতে চায় না। কিন্তু যেভাবে মেঘ জমছে, তাতে এত বেলায় ওপর থেকে এভারেস্ট বা অন্য পর্বতশিখর আবার দেখা যাবে এমন কোনো ভরসা নেই।
পাহাড় থেকে নেমে হোটেলে পৌঁছে দেখি, বেলা হলেও এখন সবাইকে নাশতা দেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ এখনই খেয়ে নিয়ে ফিরতি ট্রেক শুরু করবেন। প্রথম দিনে যাঁরা আমার সঙ্গী ছিলেন, তাঁদের অনেকে গোকিও রি-তে আরোহণ শেষেই পরবর্তী গন্তব্যের দিকে চলে যেতে শুরু করেন। বিকেলে আমার ট্রেক-সঙ্গীদের অনেককেই আর খুঁজে পাই না। এ সময় আমি গাইড তেজের সঙ্গে নির্মলের দেওয়া দৈনিক পরিকল্পনার কাগজ নিয়ে বসি। বাকি পথের ট্রেক ও বিরতি ঠিক করব।
এখানে আরও এক দিন থাকব, সেটা নামচেবাজার থাকতেই ঠিক করেছিলাম। আর ফেরার পথে ফোর্টসে পর্যন্ত না গিয়ে ডোলেতেই থামব। এ ধরনের ছোট ছোট পরিবর্তন কঠিন কিছু না। তেজ বলে রাখে, একটু কঠিন হতে পারে পরের দিন ফিফথ লেক পর্যন্ত ট্রেক করে ফিরে আসা। শুরু করতে হবে খুব ভোরে।
আরও পড়ুন