ফ্ল্যামেনকো বা ফাদোর মতো কেন সমাদৃত হচ্ছে না মণিপুরি রাস উৎসব
আন্দালুসিয়ার ফ্ল্যামেনকো, লিসবনের ফাদো কিংবা কেরালার কথাকলির চেয়ে শ্রীমঙ্গলের মণিপুরি রাসমেলা বা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসব কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু আমাদের এসব উৎসব দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও আগ্রহোদ্দীপক হয়ে উঠছে না কেন? বিভিন্ন দেশের উৎসবে হাজির হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন তানজিনা হোসেন
ফ্ল্যামেনকো দেখতে চাই—হোটেলে এই ইচ্ছা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই রিসেপশন থেকে ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পর্যটকদের একটি গ্রুপ নিয়ে সন্ধ্যায় একটা মিনি ভ্যান ছাড়বে, জিপসি গ্রামের উদ্দেশে, চাইলে আমরা নাম লেখাতে পারি। আন্দালুসিয়ার ভিনতা এল গালো নামের একটি পাহাড়ি গুহায় বসবে এসকুয়েলা ফ্ল্যামেনকো জিপসি দলের পরিবেশনা, সঙ্গে হালকা খানাপিনাও থাকবে। যে গাইড এলেন নিতে, তিনি নিজেই একজন জিপসি। লম্বা আলুথালু চুল, ভাবুক দুটি চোখ আর দৃষ্টিতে দ্রোহ। তার কাছে স্প্যানিশ সংগীতের বর্ণাঢ্য ইতিহাস আর ফ্ল্যামেনকোশিল্পীদের বঞ্চনা দ্রোহের এক ‘অপর’ বর্ণনা আমাদের সেই ভ্রমণটিকে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা। স্প্যানিশ জিপসি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নাচ ফ্ল্যামেনকো আরব ও ইউরোপীয় মিউজিকের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। কাঠের স্টেজের ওপর জুতার ছন্দোবদ্ধ ঠকঠকানি, স্কার্টের ঘূর্ণন আর তীব্র ও উচ্চ স্কেলের সংগীত স্প্যানিশ ভাষা না–জানা দর্শককেও মুগ্ধ করে।
ভিনতা এল গালোতে সেই অনবদ্য পরিবেশনা শেষ হয়েছিল গভীর রাতে, আন্দালুসিয়ার পাহাড়ে তখন চেপে বসেছে অন্ধকার রাত, দূরে আল–হামরা প্রাসাদের ম্লান হলুদ আলো, গাড়ি আমাদের আবার হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিল প্রায় শেষ রাতে। গোটা ব্যবস্থাপনা এত নিখুঁত ও নিরাপদ যে কেউ একা একা উপভোগ করতে চাইলেও কোনো সমস্যা হবে না।
পর্তুগালের লিসবনের উপকণ্ঠে প্রাচীন আলফামা অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী ফাদো দেখতে অবশ্য আমরা দুই বান্ধবী নিজেরাই অনলাইনে রিজার্ভেশন করেছিলাম। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম পেরেরিনহা দো আলফামা নামের প্রাচীন রেস্তোরাঁয়। প্রায় শত বছরের পুরোনো রেস্তোরাঁ, পাথরের তৈরি দেয়াল, নিচু ছাদ। ঘেঁষাঘেঁষি সব টেবিল–চেয়ার। রাত ৯টায় প্রথমে নৈশভোজ পরিবেশন করা হয়, পর্তুগাল মাছের জন্য বিখ্যাত, তাই মেনুতে গোটা মাছ আর ম্যাশড পটেটো, সঙ্গে ভেজিটেবল। নৈশভোজ শেষে একে একে এসে দাঁড়ান ফাদোশিল্পীরা। অনুরোধ করেন, কেউ যেন ছবি না তোলেন, ভিডিও না করেন, কারণ এতে তাঁদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। ফাদো এক বিষণ্ন দূরাগত সংগীত, এর বেদনা উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে। নাবিক, ডকশ্রমিক, জেলে, বোহিমিয়ান ও নিচুতলার মানুষের গান হলো ফাদো। তারপর ঘরের আলো কমে এলে দুজন পুরুষ বাদকের মূর্ছনার মধ্যে রেস্তোরাঁর মাঝখানে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়ান অনিন্দ্যসুন্দর বিষণ্ন এক নারী, মাথায় ঘন কালো কোঁকড়া চুল, পরনে কালো পোশাক। তিনি এক বিখ্যাত ফাদোশিল্পী, নাম জোয়ানা ভেগা। খোলা গলায় বাদ্যযন্ত্রের অনুষঙ্গে তিনি শুরু করেন এক ভীষণ হৃদয় বিদীর্ণ করা গান। ভাষা না বুঝলেও সে সুরের বিষাদ আর হাহাকার সবাইকে ছুঁয়ে যায়। বাইরে তখন শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। এক আশ্চর্য সুন্দর অভিজ্ঞতার পর রাত প্রায় ১২টায় আমরা দুজন নারী রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আলফামার ঘিঞ্জি গলিতে কয়েক মিনিট তুমুল বৃষ্টিতে ছাতামাথায় দাঁড়াতেই এসে থামল ট্যাক্সি। লিসবনে গভীর রাতেও এমন ট্যাক্সি মেলে, আর আলফামায় তো সবাই ফাদো দেখতেই যায় গভীর রাতে, তাই ফেরার জন্য দুশ্চিন্তা না করতে বলেছিল হোটেলের রিসেপশনের লোকটি।
রাজস্থানের জয়সলমিরে দিনের বেলা সোনার কেল্লা দেখে ফেরার সময় ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে আমি আর আমার কিশোর ছেলে আলাপ করছিলাম কীভাবে রাতের বেলা ডেজার্ট সাফারি করা যায়। ট্যাক্সি অবশ্য আমরা হোটেল থেকেই নিয়েছিলাম, নিরাপত্তার কথা ভেবে। এ তো আর ইউরোপ নয়, এটা ভারত। তো বিকেল হতেই সে নিয়ে চলল ধু ধু থর মরুভূমির মধ্য দিয়ে, সূর্য ডুবছে মরুর বুকে, সোনালি হয়ে উঠছে বালুর পাহাড়। মরুর বুকে উটের পিঠে চড়ে সূর্যাস্তের আশ্চর্য সুন্দর সেই দৃশ্য দেখার পর গাইড কাম চালক আমাদের নিয়ে চলল আরও গভীরে, ঘুমার নাচ আর কালবেলিয়া দেখাতে। মরুভূমির মধ্যে পর্যটকদের জন্য বসানো হয়েছে সারি সারি তাঁবু, একটা তাঁবু আমরা আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। তাঁবুগুলোয় আছে ভালো মানের পরিচ্ছন্ন টয়লেট, কোনোটা আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রিফ্রেশ হয়ে নেওয়া যায়, চাইলে রাতও কাটাতে পারবেন। ওয়েলকাম ড্রিংকের পর খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে তারপর নিরামিষ ভোজ।
কয়েকটা গ্রুপের সঙ্গে আমরা মা-ছেলেও ডাইনিং তাঁবুতে ঢুকে সেই অমৃত নিরামিষ পেট পুরে খেলাম। তারপর খোলা মরুতে অন্যদের সঙ্গে গোল হয়ে বসলাম, বালুতে পাতা রঙিন গালিচার ওপর। ওপরে তারাজ্বলা আকাশ, গোল সাদা চাঁদ। একটু পর মাঝের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল আয়না আর পুঁতি বসানো ঘাঘড়া পরা দুটি মেয়ে। শুরু হলো ঘুমার। পাশেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে তীব্র উচ্চ কণ্ঠে কালবেলিয়া গাইতে শুরু করেছেন একজোড়া নারী-পুরুষ। আবাদি এলাকা থেকে ধূসর মরুতে এসে কেমন কাটছে জীবন—তা নিয়েই এই গান। ও মা, তুই আমায় বিয়ে দিয়ে পাঠালি এই ধূসর মরুতে, আমি তো ফেলে এসেছি আমগাছ আর তেঁতুলগাছঘেরা এক সবুজ গাঁ, এখানে বাতাসে ঘূর্ণিপাক দিয়ে ওড়ে বালু, লবণের বণিকদের মতো এসে পড়েছি আমি এই বুনো বাবলার প্রান্তরে। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল যেন মেয়েটার বুকফাটা হাহাকার মিলে মিশে যাচ্ছে আমার দেশের ভাটি অঞ্চলের মেয়েটার চোখের জলের সঙ্গে—কুন দিন আসিবা বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে, বন্ধু কাজল ভোমরারে!
সে রাতে অনেকেই গান–নাচ শেষে তাঁবুতে থেকে গেলেও আমরা ফিরে এসেছিলাম। গভীর নির্জন মরুর রাত, চাঁদের আলো আর গাড়ির হেডলাইট ছাড়া কোনো আলো ছিল না। কিন্তু নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা হয়নি।
দুনিয়ার অনেক জায়গায় সুযোগ পেলেই এভাবে সব পারফরম্যান্স দেখতে গেছি, বহুবার, কিন্তু ২০১৯ সালে কমলগঞ্জের শিববাজার কার্তিক মণ্ডপে পূর্ণিমা রাতে মণিপুরি বালিকাদের যে পারফরম্যান্স দেখেছি, তাকেই এগিয়ে রাখব সবচেয়ে। পাশাপাশি তিনটি মণ্ডপ, গোলাকার মণ্ডপ সাদা কাগজ দিয়ে সাজানো। বিপরীতেই বসেছেন মৃদঙ্গধারীরা, পরনে ধবধবে সাদা ধুতি, কাঁধে সাদা চাদর, মাথায় পাগড়ি। আছেন রাসধারী, শঙ্খবাদক, দুজন সূত্রধারী। রাত প্রায় ১১টার দিকে শুরু হলো সংকীর্তন—আজি হাআজেইরি রাধা বিনোদিনী, বন্ধু রগে তিরনিরকা রাধা রসর খনি, আজি হাআজেইরি রাধা বিনোদিনী নিজর প্রাণনাথ মনে প্রাণে জানে জপিরি রাই ধনি।
গোপিনীরা নেচে চলেছে। যেন কুঞ্জবনে পদ্ম ফুটেছে। যেমন সুন্দর সুর আর লয়, তেমনই সুন্দর নাচের মুদ্রা আর তাল, আর কী সুন্দর পোশাক। তারপর মণ্ডপ আলো করে এল রাধারূপী ছোট্ট বালিকা। মিষ্টি মুখটি পাতলা সাদা ইনাফিতে ঢাকা, গাভর্তি গয়না, কপালে চন্দনের ফোঁটা। তারপর সারা রাত, হিসাব করলে টানা সাত ঘণ্টা এই ছোট্ট মেয়েটি কী আশ্চর্য শক্তি আর তেজে একটুও ক্লান্ত না হয়ে নেচে গেল তা এখনো আমার কাছে বিস্ময়। রাসলীলা চলে রাতজুড়ে, ভোর অবধি। হাজার হাজার মানুষ এ উপলক্ষে জড়ো হয় কমলগঞ্জে। রাস দেখতে আমি সেবার একাই গিয়েছিলাম, উঠেছিলাম কমলগঞ্জের একটি রিসোর্টে। আগের দিন স্থানীয় সাংবাদিক আর দুজন সাহিত্যিক ও অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যাওয়ায় তাঁদের দলেই ভিড়ে গিয়েছিলাম। নয়তো এই প্রচণ্ড ভিড়ভাট্টায় একটু অস্বস্তিতেই হয়তো পড়তে হতো। সারা রাত টয়লেট চেপেই রাখতে হয়েছে, কোনো ব্যবস্থা আছে বলে মনে হলো না। রিসোর্ট থেকে একটা সিএনজি নিয়ে যেতে হয়েছিল শিববাজারে, শেষ রাতে সহযাত্রীরা আরেকটা সিএনজি জোগাড় করে রিসোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। এই বিরাট যজ্ঞ দর্শন আসলেই ট্যুরিস্টদের জন্য এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হতে পারত, আর কেউ একা বা মেয়েরা গ্রুপ করে স্বচ্ছন্দে যেতে পারতেন যদি একটু সুন্দর ব্যবস্থাপনা থাকত। শ্রীমঙ্গল বা মৌলভীবাজারের দিকে ভালো ভালো রিসোর্ট বা হোটেল হয়েছে বটে, তবে সেখান থেকে এ ধরনের কোনো ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয় না। চাইলে শুধু রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রুপ ট্যুর পরিচালনা করতে পারেন কেউ। নিরাপত্তা আর কমফোর্টের দিকগুলো বিবেচনা করা হলে আমাদের এই উৎসব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো পর্যটনের আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারত ইউরোপের মতো। সেই সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ফ্ল্যামেনকো বা ফাদোর মতো বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হতে পারত।