যে দেশে সমুদ্রসৈকত থেকে পাথর কুড়িয়ে নিলে গুনতে হয় জরিমানা

স্পেনের অপার সৌন্দর্যময় দ্বীপপুঞ্জ ক্যানারি আইল্যান্ডসছবি: পেক্সেলস

সুন্দরকে কে না ভালোবাসে! তবে ভ্রমণপিয়াসী বহু মানুষ প্রকৃতির সৌন্দর্যকে কেবল দুচোখ ভরে দেখেই তৃপ্ত হন না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে ছবি তোলা বা ভিডিও করা তো চলতেই থাকে, প্রকৃতির খানিকটা তুলে আনার চেষ্টাও করেন কেউ কেউ। সে আপনি গাছের তলা থেকে দুটো ফুল কুড়িয়ে নিতেই পারেন, সমুদ্রতট থেকে মৃত ঝিনুকের খোল নিলেও ক্ষতি নেই। তাই বলে সমুদ্রসৈকতের পাথর, নুড়ি আর বালি! নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জায়গা থেকে বহু মানুষ যদি প্রকৃতির স্বাভাবিক উপাদানগুলো কুড়িয়ে আনেন, তবে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশই যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। প্রকৃতিতে এমন বহু উপাদান আছে, পরিবেশের ওপর যেসবের ভূমিকা অনেকে উপলব্ধিই করতে পারেন না। আমাদের একেবারে নিজস্ব সম্পদ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কথাই ধরা যাক। চমৎকার এই প্রবালদ্বীপের বাস্তুতন্ত্র বিচিত্র। প্রবারের ছোট্ট একটা অংশ তো কেবল মামুলি পাথর নয়, একে ঘিরে টিকে থাকে বিশাল জীববৈচিত্র্য। তেমনিভাবে বালু, পাথর বা নুড়ির মতো জড় পদার্থও পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য। জনে জনে এসব কুড়িয়ে নিলেই বিপদ। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র এসবের ওপরও নির্ভর করে।

স্পেনের অপার সৌন্দর্যময় দ্বীপপুঞ্জ ক্যানারি আইল্যান্ডস। এরই দুটি দ্বীপ লানযারোতে ও ফুয়ের্তেভেন্তুরা। লানযারোতে দ্বীপের সৈকতে আছে আগ্নেয়গিরির উপাদান, যা থেকে বছরে প্রায় টনে টনে কুড়িয়ে নিয়ে যান পর্যটকেরা। ফুয়ের্তেভেন্তুরার ‘পপকর্ন বিচ’ থেকে প্রতি মাসেই অবিশ্বাস্য পরিমাণে বালু নিয়ে যান ঘুরতে আসা মানুষজন। তাই এই দুই দ্বীপের সমুদ্রসৈকতে বালু, পাথর, নুড়ি কুড়িয়ে নেওয়া থেকে পর্যটকদের বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক পোস্ট।

ফুয়ের্তেভেন্তুরার ‘পপকর্ন বিচ’ থেকে প্রতি মাসেই অবিশ্বাস্য পরিমাণে বালু নিয়ে যান ঘুরতে আসা মানুষজন
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

নির্দেশনা অমান্য করলে দিতে হবে জরিমানা। জরিমানা হতে পারে ১২৮ পাউন্ড থেকে ২ হাজার ৫৬৩ পাউন্ড পর্যন্ত। পপকর্ন আকৃতির নুড়ি কুড়িয়ে নিলে জরিমানা হবে ১২৮ থেকে ৫১২ পাউন্ড পর্যন্ত। কতটা কুড়িয়েছেন, তার ওপর নির্ভর করছে জরিমানার অঙ্কটা কম হবে না বেশি। তবে বিমানবন্দরে পর্যটকদের কাছে এ ধরনের উপাদান পাওয়া গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য এটা প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না যে কুড়িয়ে নেওয়া জিনিসটি সংরক্ষিত অঞ্চল থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে কি না।

ক্যানারি আইল্যান্ডের সর্ববৃহৎ দ্বীপ তেনেরিফ। স্পেনের উচ্চতম পর্বত মাউন্ট তেইদির অবস্থান এই দ্বীপেই। সম্প্রতি ভয়াবহ খরার কারণে পানিজনিত জরুরি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তেনেরিফ। সেখানে এমন হোটেলও আছে, যার কেবল একজন পর্যটকের জন্য একজন স্থানীয় অধিবাসীর চেয়ে চার গুণ বেশি পানি খরচ হয়। স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা ১০ লাখের কম। অথচ গত বছর সেখানে ৫০ লাখের বেশি পর্যটক গেছেন। তাই পরিবেশবিশেষজ্ঞরা মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। এরই মধ্যে তেনেরিফে বাগান এবং পুলের জন্য খাওয়ার পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশেও আমরা অনেকে সৌন্দর্যের টানে কোথাও ঘুরতে গিয়ে প্রকৃতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিই। অনেক বছর আগের তেমন দুটি চিত্র আজও মনে পড়ে আমার। ২০০৯ সালে সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রতটে লক্ষ করি, ছোট এক প্রবাল পাথর ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন এক ব্যক্তি। নিষেধ করেছিলাম তাঁকে, কিন্তু বুঝিয়ে বলতে পারিনি বিষয়টার গুরুত্ব। আবার এ দেশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা নিসর্গের কোলে ফেলে আসেন অপচনশীল বর্জ্য। ২০১৮ সালে নিজ চোখে দেখা সুনামগঞ্জের জলাশয়ে বিভীষিকার মতো ভেসে থাকা বর্জ্যের ছবিটা হয়তো মনে থাকবে বহু বছর। আইনের সহায়তায় এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আরও নানান উপায় অবলম্বন করে ক্যানারি আইল্যান্ডস হয়তো রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের লাবণ্যময় রূপ আর জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে কি?

সূত্র: এনডিটিভি