মার্টিন লুথার-এলভিসের শহরে
মেমফিস শহরটার বিলবোর্ড, অলিগলি, দোকান—সবকিছুই এলভিসময়। গ্রেসল্যান্ডে হাঁটতে হাঁটতে একটা সময়ে আমার মনে হয়েছে, আমার পাশেই হাঁটছেন সেই সুরের জাদুকর। সরাসরি আমি যেন তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। গত নভেম্বরে মেমফিস ঘুরতে গিয়ে আমার ঘোরের মধ্যে কেটেছে।
ঐতিহাসিক মিসিসিপি নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর মেমফিস। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি স্টেটের দক্ষিণ পশ্চিমের শহর। টেনেসির রাজধানী ন্যাশভিল থেকে বাসে যেতে মোটামুটি চার ঘণ্টা লেগে যায়। মেমফিসের ইতিহাস বেশ পুরোনো। এর কারণ, মিসিসিপি নদী। একসময় সভ্যতা গড়ে উঠত নদীকে ঘিরে। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপিয়ান বণিকেরা মেমফিসে আসতে শুরু করেন। উনিশ শতকে মেমফিস দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ তুলা আর মাস্তুল কাঠের বাজারে পরিণত হয়। মেমফিস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্গো এয়ারপোর্ট। এই বিমানবন্দর থেকে ফেডেক্স সারা দুনিয়ায় তাদের ব্যবসা পরিচালনা করে। কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়ে মেমফিসের প্রধান পরিচয় এটা সংগীতের তীর্থ। এই শহরকে বলা হয় কান্ট্রি মিউজিক, ব্লুজ, সোল আর রক অ্যান্ড রোলের জন্মভূমি।
একসময় আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্টের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় মেমফিস। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সংঘবদ্ধ এই আন্দোলন আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে আফ্রো-আমেরিকান জনগোষ্ঠীর চাকরি, সম্পত্তি, ভোটদান থেকে শুরু করে সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে বলা হয় এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা। ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল তিনি মেমফিসের লরেন মোটেলের ৩০৬ নম্বর রুমের বারান্দায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্মরণে এই হোটেলেই পরে গড়ে ওঠে ন্যাশনাল সিভিল রাইটস মিউজিয়াম। আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্টের এক জীবন্ত ইতিহাস এই জাদুঘর।
‘কিং অব রক অ্যান্ড রোল’ এলভিস প্রিসলির বাসভূমি এই মেমফিস। আফ্রো-আমেরিকান সংস্কৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল তাঁর গান। যা তাঁকে বর্ণ-গোত্র, সময়ের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। বিখ্যাত এই মানুষের গান শুনেছি, তাঁর জন্মস্থানে এসে যেন প্রিসলির ছায়া অনুভব করলাম। গ্রেসল্যান্ডের জাদুঘরে তাঁর অভিনয়, গানসহ আরও অনেক শখের অনুষঙ্গের দেখা মিলল। ১৩ দশমিক ৮ একরের এই প্রসাদে এলে পঞ্চাশের দশকে বিশ্বমাতানো সেই রকস্টারকেই যেন আপনি খুঁজে পাবেন।
ফিরে আসার দিন আমি আরকেড রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম। এটি মেমফিসের সবচাইতে জনপ্রিয় আর পুরোনো নাশতার জায়গা। সান স্টুডিওতে রেকর্ডিং শেষে এখানে প্রায়ই খেতে আসতেন এলভিস প্রেসলি। আর ভক্তরা তো জানেনই, এই সান স্টুডিওতেই জন্ম নেয় ‘রক অ্যান্ড রোল’ ব্যান্ড। ১৯১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মেমফিসবাসী আর এখানে আসা পর্যটকদের কাছে অরকেড রেস্তোরাঁ তাই স্মৃতি রোমন্থনের অন্যতম জায়গা।
মেমফিস শহরটা ‘হোম অব ব্লুজ’ নামেও পরিচিত। মেমফিসের কেন্দ্রবিন্দু ডাউন টাউনের ‘বিয়েল স্ট্রিট’কে বলা হয় আমেরিকার আইকনিক স্ট্রিট। ঝলমলে আলো, বাহারি বার-রেস্তোরাঁ, দোকানে-সড়কে লাইভ মিউজিক, নানা ঢঙের বাদ্যযন্ত্র হাতে তরুণ-তরুণীর সমাগমে জমজমাট এই বিয়েল স্ট্রিট। জমজমাট এই এলাকা রাতের মেমফিসকে একেবারে অন্য আবহে নিয়ে যায়। এখানে উঠতি শিল্পীরা খুব নিষ্ঠা আর ভালোবাসা নিয়ে গান করেন সন্ধ্যা থেকে। কখনো শত শত করতালি তাঁদের নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখায়। এই রাস্তায় ভিড়েও মাঝেমধ্যে জটলা তৈরি করে শারীরিক কসরত দেখান বাজিকরেরা। বৃষ্টির সন্ধ্যায় বিয়েল স্ট্রিটের এক কোণে কখনো বেহালার করুণ সুর ভেসে আসে।
পৃথিবীর বেস্ট সেলিং সলো মিউজিক আর্টিস্ট এলভিস প্রেসলি ছাড়াও জনি ক্যাশ, চার্লি, এন্ডিসহ শ খানেক মিউজিশিয়ানের জন্ম আর বিকাশ এই শহরেই হয়েছে। জাস্টিন টিম্বারলেকের মতো আধুনিক শিল্পীরও জন্ম দিয়েছে মেমফিস। বড় বড় গিটার দিয়ে সাজানো শহরটি যে কান্ট্রি মিউজিক, ব্লুজ, সোল, রক অ্যান্ড রোল আর গসপেল মিউজিকের স্বর্গ, তা যে কেউ অনুভব করতে পারবেন। অচেনা রাস্তা, উবার, বিমানবন্দর, রেস্তোরাঁ—সবখানেই সংগীত আর মিসিসিপি নদীর শাখা-প্রশাখা গোটা মেমফিসকে অন্য এক মায়ায় ঘিরে রেখেছে। সত্যি বলতে, পুরোটাই আমার কাছে একটা সাইকেডেলিক এক্সপেরিয়েন্স।
লেখক: হিউবার্ট হামফ্রি ফেলো (ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট), ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি