দেবতাখুমে বিপদ
পাহাড়প্রেমীদের কাছে বান্দরবান স্বর্গের মতো। পাহাড়ের নতুন কোনো রূপের সন্ধানে বারবার সেখানে ছুটে যান তাঁরা। একজন পাহাড়প্রেমী হিসেবে বলতে পারি, বান্দরবান কখনোই আমাকে নিরাশ করেনি। যখনই গিয়েছি, মুগ্ধতা নিয়েই ফেরত এসেছি। পাহাড়ে গেলেই বুঝতে পারি, কত ঠুনকো আমাদের শহুরে জীবন।
বান্দরবানকে নতুন করে আবিষ্কার করতে মাঝেমধে৵ই তাই বেরিয়ে পড়ি। এই পরিক্রমায় গত বছর গিয়েছিলাম বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার দেবতাখুমে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটি পাহাড় মাঝখান থেকে দুই ভাগ হয়ে গেছে। আর দুই পাহাড়ের ঠিক মধ্য দিয়ে নেমে এসেছে কলকল জলধারা। ঝিরির এই কলকল শব্দ, শহরের শব্দদূষণকে মুহূর্তেই ভুলিয়ে দিয়ে মনকে করে প্রশান্ত। তবে এই শান্তি বেশিক্ষণ থাকল না। দেবতাখুমের একেবারে ভেতরে নৌকা কিংবা ভেলা ছাড়া যাওয়া–আসার অন্য কোনো উপায় নেই। আমরা সাত-আটজন একটি নৌকা নিয়ে সেই গহিনে পৌঁছে যেতে পারলেও ফেরার সময় পড়তে হলো বিড়ম্বনায়। নৌকা বা ভেলা কোনো কিছুই আর আমাদের নিতে আসছে না। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের অপেক্ষা যখন এক ঘণ্টায়ও শেষ হলো না, তখন সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। এদিকে কলকল শব্দে পানি বেড়ে চলেছে। কিছুক্ষণ আগেই যে শব্দ শান্তি দিচ্ছিল, সেই শব্দই এখন ভয়ের কারণ।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর একটি নৌকা আমাদের উদ্ধার করল। তারপরও কিন্তু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছিলাম না আমরা। কারণ, নৌকা দিয়ে কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়া যাবে; বাকি দুই–তিন ঘণ্টার পথ যেতে হবে হেঁটে। এই পথে আছে পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তা আর ঝিরিপথ। বিকেল বা সন্ধ্যার পর খুমের ভেতর সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। বিষধর সাপ, পোকামাকড় ও পিচ্ছিল রাস্তা এই স্থানকে করেছে বিপজ্জনক।এমনিতেও পাহাড়ি রাস্তা দিনের আলোতে যতটা সুন্দর, রাতের অন্ধকারে ততটাই ভয়ংকর।
নৌকায় যতটুকু পাড়ি দেওয়া যায়, দিলাম। একটু হেঁটে আরেকটি নৌকার জন্য আবার অপেক্ষা। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। খুমের ভেতর থেকে ফিরে আসার দুটি পথ। একটি পাহাড়ি রাস্তা, অন্যটি ঝিরি রাস্তা। আমাদের জন্য দুটি একই হলেও স্থানীয় গাইড আমাদের জানান, ঝিরির রাস্তায় তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব।
বাধ্য শিশুর মতো তাঁর দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করলাম। অনেক বেশি পিচ্ছিল ও সরু রাস্তা। পায়ে ট্রেকিং জুতা আর হাতে লাঠি থাকলেও খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। একটু পা হড়কালেই একদম ঝিরিতে গিয়ে পড়তে হবে। এদিকে পাহাড়ের গায়ে হাত দিয়ে ভারসাম্য ঠিক রাখার উপায়ও নেই, সেখানে থাকতে পারে বিষধর পোকামাকড় বা সাপ। এভাবেই সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমরা ঝিরির রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, সম্বল একটি লাঠি আর মুঠোফোনের টর্চলাইট। এরই মধ্যে হঠাৎ আকাশে চোখ গেল। আকাশে তখন তারার মেলা। নাহ, আমার মনে পড়ে না, শেষ কবে এত তারা একসঙ্গে দেখেছি। মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম কোথায় আছি। চোখ সরাতেই পারছি না যেন। সামান্য অন্যমনস্ক হওয়ার কারণে স্লিপ করে পায়ে বেশ ব্যথা পেলাম। তবুও কিছু করার নেই, হেঁটে যেতেই হবে।
বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর মনে হলো, গাইড নিজেই যেন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন। ফোন করে কারও কাছে সাহায্য চাওয়ারও উপায় নেই। কারণ, এখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আর কোনো পথ নেই। সামনে আর পাশে ঝিরি, অন্যদিকে উঁচু পাহাড়। কিছুক্ষণ সেখানেই অপেক্ষা করলাম। গাইড ঝিরিতে লাঠি দিয়ে পানির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে। সে জানালো এই ঝিরি হেঁটেই আমাদের পাড়ি দিতে হবে।
গভীরতা তিন ফুটের বেশি হবে না। উপায় না দেখে ঝিরির পানিতে নেমে পড়লাম। লাঠি ফেলে ফেলে পানির গভীরতা দেখতে লাগলাম। ঝিরির পানি স্বচ্ছ, কিন্তু অন্ধকারে কারণে খালি চোখে গভীরতা বোঝার উপায় নেই। এভাবে আরও তিনটি ঝিরি আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে। পরে জানতে পারি জায়গাটা সাপ, বড় বড় কাঁকড়া, জোঁক আর বিষধর পোকার আস্তানা।
দুই ঘণ্টা হাঁটার পর, একপর্যায়ে প্রশস্ত একটা জায়গায় এসে পৌঁছাই। স্থানীয় একজন লোক আমাদের রাস্তা চেনাতে অনেক সাহায্য করে। বাকিরা তখনো অনেকটা দূরে। হুট করে আমার এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল দুটি। এক একটু দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে আকাশ ভরা তারা দেখা আর দুই, বাকিদের জন্য অপেক্ষা করা।
বাকিরা আসার পর আবার হাঁটতে শুরু করি। ৩০ মিনিটের মধ্যেই খুমের ভেতর থেকে বের হয়ে আসি। বের হয়েই প্রথমে যে যার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আট থেকে নয় ঘণ্টা আমরা পুরো নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম। পরিবারের মানুষেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
প্রায় প্রতিবারই পাহাড়ে গেলে আমার নতুন নতুন উপলব্ধি হয়। কিন্তু এবারের উপলব্ধি জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। আমরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি ছিলাম, তাই হয়তো মৃত্যুকেই সবচেয়ে বেশি সুন্দর মনে হচ্ছিল। এভাবে প্রায় অক্ষত ফিরে আসা আমাদের জন্য নতুন জীবন পাওয়ার মতোই। মনে হচ্ছিল প্রকৃতিই যেন আমাদের মায়ের মতো আগলে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে।