এক রাতের মামলা!
মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন নবম পর্ব
হোটেল ভাড়া বেশি হওয়ায় সামনে এগোতে হবে। এমন সময় গাড়ি ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমন গাড়ি দরকার, যাতে দুটি সাইকেলসহ আমরা যেতে পারি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলাম সবাই। জুতসই গাড়ি পাওয়া গেল না। এদিকে দিন গড়িয়ে বিকেল শেষের পথে। রোদ নেই বললেই চলে। এবার একটি বড় মাইক্রোবাস পাওয়া গেল। ড্রাইভারের সিটের পরে যাত্রীদের বসার জন্য যে জায়গা, তাতে কোনো সিট নেই। মাল টানার জন্য ফাঁকা। এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে! ১০০ ডলারে রফা হলো। কিচ্ছু করার নেই। সাইকেল তুলে গাড়ির গায়ের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে আমরা হেলমেট পরে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে ড্রাইভারের পাশে দুজন বসা। তমাসিনা পর্যন্ত যাবে গাড়ি। আমরা সে পর্যন্ত যেতে চাই না। রাস্তা ভালো। দারুণ চালানো যাচ্ছে, তাই এর আগে যদি কোনো থাকার জায়গা মেলে, সেখানেই নেমে যাব। এ কথাগুলো ড্রাইভার সাহেবকে বুঝিয়ে দিলেন ফরেস্ট রেস্টুরেন্টের নারী।
পড়ন্ত বিকেলে গাড়ি দ্রুততার সঙ্গে চলতে শুরু করল। রাস্তা আরও সমতল হলে কী দারুণ করে চালানো যেত। এমনই হয়, যখনই গাড়িতে ওঠা হবে, রাস্তা হয় সমতল, না-হয় ঢালু। এটা যে কেন হয়, তার উত্তর পাওয়া যায়নি। আধঘণ্টা হবে। উইন্ডশিল্ড দিয়ে সামনে একটা গ্যাসস্টেশন চোখে পড়ল। দু-একটা রিকশা আছে রাস্তায়। রিকশা মানে সমতল রাস্তা। দোকানপাট যত্রতত্র। ছোট শহর আরেকটা। সাইনবোর্ডে ব্রিকাভিল নামটা পড়া গেল। গ্যাস স্টেশন পার হয়ে গাড়ি একটি দ্বিতল বাড়ির সামনে এসে থামল। এবার খেয়াল হলো, সাইনবোর্ডটা ‘হোটেল ক্যাপরিকর্ন ব্রিকাভিল’, কোনো এককালের সাইনবোর্ড। রোদে জ্বলে গিয়ে এতই হালকা হয়ে গেছে যে কাছে না আসা পর্যন্ত পড়তে পারা দুষ্কর।
মালামাল না নামিয়ে দেখা হলো, আদৌ রুম পাওয়া যাবে কি না। পাওয়া যাবে। দুটি রুম দিতে পারবে। ভাড়া খুব কম। ১৫ ডলার করে এক রুম। সাইকেলসহ সবকিছু নামিয়ে নিলাম। ভাড়া মিটিয়ে নিচতলায় সবকিছু রাখলাম। রুম যে দুটি পাওয়া গেল, তার একটি এই ভবনের দোতলায়। রুমের যা অবস্থা, তাতে রাতে থাকাও কঠিন। বাথরুম যাচ্ছেতাই। এই রুমে থাকা যাবে না। কিন্তু আর তো কিছু করার নেই। দোতলার রুমটা নিচতলার চেয়ে ভালো; কিন্তু এটাও যে ভালো, তা বলা যাবে না। বাথরুমের কোনো দরজা নেই। একটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা মাত্র। একটি খাট, তার সঙ্গে টেবিল আর চেয়ার। ভালো ব্যাপার একটাই—সামনের বারান্দাটা বড়। সাইকেল দুটিই রাখা যাবে। রুমটা বেশি হলে ১২ ফুট বাই ১২ ফুট হবে। একটি করে দরজা-জানালা। ফ্যান আছে। বিদ্যুতের পোর্ট আছে। ক্যামেরা ও মুঠোফোন চার্জ দেওয়া যাবে।
প্রথমে সবকিছু দোতলায় নিয়ে এলাম। ব্যাগগুলো রুমের ভেতরে। পইপই করে বলে দিয়েছে, কোনো কিছু বাইরে না রাখতে। সাইকেলগুলোও নয়। বলে কী? সাইকেল রাখি কোথায় তাহলে? কিছু একটা করা যাবে। আগে ধাতস্থ হয়ে নিই। আজকের এই গাড়িতে ওঠাটা একেবারে দুর্ঘটনামূলক। মন-মেজাজ সবার একরকম নেই। আলবত চলে আসা যেত, যদি জানতাম এখানে এই হোটেল পাওয়া যাবে। ১০০ কিলোমিটার হতো হয়তো, তবে পারা যেত। এখন যেখানে এলাম, এখানে থাকাটা নিতান্তই অনিচ্ছায়। পালা করে বাথরুম ব্যবহার করা হলো। একজন গেলে বাকিরা বারান্দায় অপেক্ষা করে। দিনের আলো আছে এখনো। সাইকেলগুলো ভালো করে দেখা হলো। খোয়া যায়নি কোনো কিছু। গাড়িতে ওঠার ভয় একটাই।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে রাতের খাবারের জন্য বের হলাম। এখানে সে অর্থে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, তা হোটেল থেকে জানা হলো। এগিয়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের হাঁটাপথে একটা ভাতের হোটেল পাওয়া যাবে ডান দিকে। আমরা ওই দিকে গেলাম। পাওয়াও গেল। এমন হোটেলের নাম ঢাকায় ‘হোটেল আল ছালা দিয়া ঢাকা’। ব্যঙ্গাত্মক নাম। এমন নামের কারণ হলো, হোটেলে ঢোকার মুখে দরজায় একটা পাটের পর্দা ঝোলানো থাকে। পাটের কোনো কিছুকে আমরা ছালা বলি। এই ছালা দিয়ে দরজা ঢাকা থাকে বলে ‘ছালা দিয়া ঢাকা’ হোটেল। এই হোটেলও তা-ই। পর্দা অবশ্য কাপড়ের। ভেতরে তিনটা টেবিল। একটি টিভি চলছে। টেবিলগুলো পরিষ্কার। একটু হোঁচট খাওয়া হলো। এমন হোটেলে মাদাগাস্কারে খাওয়া হয়নি আগে। গরুর মাংস আছে। মাছও আছে। তবে মাছ আর নেওয়া হলো না। মাংস, ডিম পোচ আর সাদা ভাত। ভাত খেতে দারুণ স্বাদের। মাংস এরা ভালো পাকায়। আমাদের মতো নয় যদিও, তবে খেতে ভালো। ভরপেট খাওয়া গেল। হিসাবে প্রতি প্লেটের খরচ ২০০ টাকা বা একটু কমই। দাম বেশি নয়। এর থেকে বেশি কিছু খাবারও নেই। মাংসের সাইজ বড়, তাই একটাতে হয়ে যায়।
রুমে এসে এবার ম্যাট্রিক্সের সূত্র ধরতে হলো। চারজন মানুষ। একটা খাট। দুটি সাইকেল। ১২টা ব্যাগ। ৪টা হেলমেট। ৮ জোড়া জুতা–স্যান্ডেল। এসব কিছু নিয়ে ঢুকতে হবে ১২ ফুট বাই ১২ ফুটের কামরায়। ম্যাট্রিক্স ছাড়া সম্ভব কি!
যা করা হলো—সালমা আপা ও শামিমা আপা খাটে শোবেন। খাট থেকে নেমেই বাথরুমে যাওয়ার জন্য যে এক ফুট জায়গা আছে, তাতে একটা সাইকেলের সামনের অংশ ঢুকে যাবে। বিপদে পড়ে যদি কারও বাথরুমে যেতে হয়, তাহলে খাটের ওপর দিয়ে যেতে হবে। আরেকটি সাইকেল এখনো বারান্দায়। প্যানিয়ার ব্যাগগুলো খাটের নিচে, টেবিলের ওপর—যেখানে গুঁজে দেওয়া সম্ভব। দুটি প্যানিয়ার বাইরে রাখা হলো। নিচতলার রুম থেকে চাদর আনা গেলেও তোশক বা বালিশ নেওয়া গেল না। মশারি নেওয়া হলো। কালশিটে দাগগুলো কোয়েসারের মতো জ্বলজ্বল করছে। চাদর পরিষ্কার। আরেকটা করে চাদর পাওয়া গেল চেয়ে। দুই পরত চাদর বিছানো হলো মেঝেতে। প্যানিয়ার দিয়ে বালিশ। আমরা শুয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আরেকটা সাইকেল ভেতরে নিয়ে আসা হলো। আড়াআড়ি করে আমাদের পাশ দিয়ে রেখে দরজা বন্ধ করা হলো। সাইকেল না টপকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। বিশাল অবস্থা। এক রাতের মামলা।