বাংলাদেশের নাম শুনলেই জিজ্ঞেস করে, ‘ইয়োর কান্ট্রি প্রবলেম ফিনিশড?’
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন পঞ্চদশ পর্ব।
পঞ্চদশ দিন: ইয়ালাবোওয়া থেকে মহাগালওয়েয়া। দূরত্ব ৪৬.১৬ কিলোমিটার।
থোমাশা হোম স্টের খোলা আঙ্গিনায় অনেক ফলগাছ। ফলের ভারে সব গাছেরই নুয়ে পড়ার দশা। সাধারণ শ্রীলঙ্কান লোকজন রাজনীতি সচেতন। বাংলাদেশ নাম শুনলেই জিজ্ঞেস করে, ‘ইয়োর কান্ট্রি প্রবলেম ফিনিশড?’ হোম স্টের মালিক থোমাশাও ব্যতিক্রম নন। ওয়ার্ম আপ করতে করতে সকাল সকাল তাঁর সঙ্গে খানিকটা রাজনীতিচর্চা হলো।
পথে নামতেই উইপোকা আর উইপোকা। আর আছে হরেক রং আর রকমের গিরগিটি। উইপোকা খাওয়ার মচ্ছবে মেতেছে ওরা। রাস্তার ধারে সুগার মিল পড়ল একটা। ভেতরে উঁকি দিচ্ছে মাঝারি উচ্চতার আখখেত। লম্বা বেণি দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে মেয়েরা। নুগেইয়াইয়াতে একটা স্কুলের জাতীয় সংগীত পরিবেশন দেখা ও শোনার সুযোগ হলো। কেউ অবশ্য ওই সময় অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ায় না। যে যেখানে আছে, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে ঠোঁট মেলায় স্পিকারে বাজা সংগীতের সঙ্গে। জেব্রা ক্রসিংয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য দাঁড়ানো শিশুটিও ওখানে দণ্ডায়মান থেকেই গলা মেলাচ্ছে। কিংবা ক্যান্টিনে বড়া মুখে দেওয়া শিশুটিও ওখান থেকেই কোরাসে গাইছে।
এ দিকের বেশিরভাগ বাড়ির উঠানে শোভাবর্ধন করছে নীলমণিলতা ফুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া অসম্ভব সুন্দর নামের কারণেই সম্ভবত এই ফুলটিকে মনে হয় আরও মোহনীয়। আন্ডাওয়ালেলাইয়াইয়া ছাড়িয়ে হান্ডাপানাগালা। রাস্তা পারাপারের সময় প্রচুর গিরগিটির দেহ থেঁতলে পড়ে আছে কালো পিচে। সড়ক দুর্ঘটনায় শ্রীলঙ্কায় এই প্রাণীটিই কি সবচেয়ে বেশি মারা যায়? অবশ্য মানুষের চাপে পিষ্ট এই দুনিয়ায় রং বদলানো ছোট্ট প্রাণীর খবর রাখেই–বা কে? দোপেয়ে প্রাণীদের ভারবহন করতে করতেই পৃথিবী নামক এই গ্রহের ত্রাহি মধুসূদন দশা। নিজেদের নানান সুযোগ-সুবিধা হাসিল করার জন্য পৃথিবীটাকে আমরা নিজেরাই ভাগাড় বানিয়ে ফেলছি।
এই অঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়ির সামনেই হয় কদবেল নতুবা মাটির হাঁড়িতে দই বিক্রি হচ্ছে। কদবেল শ্রীলঙ্কায় হরদম চোখে পড়ে। ওয়েহেরবিয়াইয়ায়াতে নাশতা খেতে বসে দেখলাম দূর থেকে দুটো ছেলে হেঁটে আসছে। হাতে শ্রীলঙ্কার পতাকা, গায়ের টিশার্টে লেখা, ‘দ্য জার্নি অব গোল’। রাস্তা পেরিয়ে ছেলে দুটোকে থামালাম। জাফনার কিছুটা নিচের জেলা কিলিনোচ্ছি থেকে হাঁটা শুরু করেছে মুরলি আর দিলনোজা। গন্তব্য হাম্বানটোটা। আজ ওদের ১৬তম দিন। ওদের ইংরেজি জ্ঞান আর আমার সিংহলা ভাষার জ্ঞান শূন্যের কয়েক ডিগ্রি নিচে হওয়ায় অনেক কষ্টে এটুকুই বুঝলাম।
নাশতার পরে হাইওয়ে ছেড়ে ডানে। একটু পরে আরও ছোট লাল মাটির রাস্তা। এরপরে সরু একটা পিচের রাস্তায় উঠে পড়লাম। এমন ছায়াঘেরা নীরব রাস্তা এই ভ্রমণে খুব একটা পাইনি। মানুষ কিংবা যানবাহন কিছুই নেই। শুধু বৃক্ষের ডালে হাওয়ার শব্দ। মাঝেমধ্যে সেই শব্দে ছেদ ফেলছে ময়ূরের উৎকট ডাক। টানা হেঁটে এটিলি ওয়েয়া নামক জলাশয়ের ধারে থামা গেল। সুন্দর হাওয়া বইছে। লেকের ধারের বিশাল পাথরে বসার লোভ সামলানো গেল না। গা এলিয়ে অনেকক্ষণ বসে ফের গাত্রোত্থান করলাম। এবারের রাস্তা জলাশয়ের ধার ঘেঁষে। খানিক পরে মোড় নিয়ে বনের ভেতরে নুড়ি ফেলা রাস্তা। নুড়ি ফেলা রাস্তায় হাঁটাটা মোটেই সুখকর না। পায়ের নিচে নুড়ি পিছলিয়ে যায় ক্রমাগত। চারপাশের দৃশ্যের জন্য কষ্টটুকু খুব একটা গায়ে লাগছে না অবশ্য। আশপাশে হঠাৎ একটা কি দুটো বাড়ি। এখানেই একটা ডালপালা ছেঁটে দেওয়া গাছে দুটো ধনেশ দেখলাম। সেই মানকুলামে সর্বশেষ দেখেছিলাম হলদে ঠোঁটের অতিকায় এই পাখি।
কিছুটা এগিয়েই কালেকান্ডা রিজার্ভ ফরেস্ট। তার মধ্য দিয়ে রাস্তা। বন্য প্রাণীর রাস্তায় উঠে পড়া ঠেকাতে পথের ধার ঘেঁষে ইলেকট্রিক বেড়া। এরই মধ্যে খুবই সাধারণ একটা সাইকেলে দুদ্দাড় গতিতে এগিয়ে এসে একজন আমাদের থামাল। জানালেন পাশের মিলিটারির কমান্ডো ট্রেনিং স্কুল থেকে তিনি এসেছেন। আমাদের দেখেই এসেছেন। শুভকামনা জানিয়ে আবার তুমুল গতি তুলে সামনের বাঁকে হাওয়া হয়ে গেলেন। আরও কিছুদূর এগিয়ে আবার পিচঢালা রাস্তা। দুই ধারে ছোট ছোট পাথুরে পাহাড়। পথ বেশ উপভোগ্য। শুধু মুশকিলে ফেলছে বিপরীত দিক থেকে আসা বাতাস। সাইক্লিংয়ের পরিভাষায় ‘হেড উইন্ড’। পথে পড়ল কুদু ওয়া নদী। আবার একটি-দুটি করে বাড়িঘর দেখা দিতে শুরু করল। এদিকে পানযোগ্য জলের বড়ই অভাব। সব বাড়িতেই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো গোলা আছে। এ অঞ্চলের মানুষের গোলা ভরা ধান না হোক, অন্তত গোলা ভরা বৃষ্টির জল আছে। সি-১০০১ নামক অপেক্ষাকৃত ছোট সড়ক ধরেই পরের পথটুকু চলা।
বালাহারুয়া বিহার থেকে একটু এগিয়েই বালাহারুয়া জলাধার। রাস্তার পাশে সর্বগ্রাসী লান্টানার ঝোপ। লান্টানা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্য উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত করে। এখানে প্রচুর গুইসাপও আছে। বুকে ভর দিয়ে রাস্তার পাশে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে স্বস্তি খুঁজছে কিংবা কিলবিলে পায়ে সড়ক পেরোচ্ছে। একবার তো একটা লরি ব্রেক কষে ওদের রাস্তা পেরোবার জায়গা করে দিল। কাহাকুরুল্লানপেলেসসা থেকে বি-৫২৮ সড়ক। এ দিকের বাড়িঘরের আঙিনায় সেই নর্দান প্রভিন্সের পর কুয়োর দেখা পেলাম।
দুপুরে খেয়ে চলা শুরু করে কিলোমিটার দুয়েক এগোতে হাতি পারাপারের করিডর পড়ল। জায়গার নাম গালকোটাকান্ডা। উদাওয়ালাওয়ি ন্যাশনাল পার্কের পাশ ঘেঁষে হাঁটছি। একেবারেই নির্জন এলাকা। এলিফ্যান্ট করিডর বলেই দুপাশে কিচ্ছু নেই। আমরা দ্রুত পায়ে হাঁটছি। জুমন ভাই রাস্তার উল্টো পাশে ছিলেন। এক মোটরসাইকেল আরোহী হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন। আমরা বুঝতে না পেরে গা করিনি। মিনিট দুয়েক বাদে আরও দুজন মোটরসাইকেল আরোহী আমাদেরকে অতিক্রম করার পথে হাত দিয়ে হাতির শুঁড়ের ইশারা করল। সংখ্যায় যে ওরা দুই সেটাও বুঝিয়ে দিল। এবার দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও অতি ক্ষীণ। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে একটা কারে লিফট নিয়ে কিলোমিটার দুয়েকের ওই এলিফ্যান্ট করিডর পেরোলাম। গাড়ির ভেতরের দুই ভদ্রলোকের একজন ভালো ইংরেজি জানেন বলে লিফট নিতে বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়নি।
এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে মহা ওয়েয়া নামক বিশাল এক জলাশয়। আনগুনাকোলাপেলেসা নামের জনপদ পেরিয়ে আবার ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। পথে চোখ আটকাল পুঞ্চি মিহিনতালেতে। বিশাল পাথরের ওপর চৈত্য আর নির্মীয়মাণ বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে জায়গাটি। আরেকটু এগিয়ে ডানের ছোটো রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তার ধারে সবগুলো অ্যাগ্রো ফার্ম। আমের বাগানই মূলত। শ্রীলঙ্কার আম দেখে অবশ্য আমোদিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের দেশীয় আম এখানকার আমের চেয়ে স্বাদে অনেক এগিয়ে।
ময়ূরের সান্ধ্যকালীন ডাক শুনতে শুনতে দিনশেষে প্রবেশ করলাম সাউদার্ন প্রভিন্সে। এটিই এই পদযাত্রার সর্বশেষ রাজ্য। জেলার নাম হাম্বানটোটা। মহাগালওয়েয়াতে দিনের শেষ পদক্ষেপটি রাখলাম। অক্টেন্ড্রা নামক লজের সামনে পৌঁছেই ফোন দিতে এক আন্টি ধরলেন। জানালাম আমি লজের সামনেই আছি। জানালেন, তিনিও লজের গেটের সামনে। আমার মতো তিনিও কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে বুঝলাম ফোন চলে গিয়েছে হাম্বানটোটার জেলা সদরে! অবশ্য আন্টি মুশকিলের আসানও করলেন। এই লজেই তার স্বামী আছেন। তিনি ফোন করতেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করলেন। রাতে আরেক ফ্যাসাদ। খাবার কিছু নেই। এই লজেই একসময় নিজস্ব বাবুর্চি ছিল। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে সব ভেসে গিয়েছে। যা হোক, রাতের খাবারের খোঁজে আঙ্কেলের বাইকে করে বেরিয়ে পড়লাম। নানা জায়গায় খুঁজে পেতে পেট ভরানোর হালকা কিছু রসদ জোগাড় করে আবার লজে।