যে দ্বীপে ১৮ বছর বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা, সেই দ্বীপটি এখন কেমন

সর্বসাকল্যে তিন দশক কারাভোগ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। এর মধ্যে ১৮ বছরই তাঁকে কাটাতে হয়েছিল রোবেন দ্বীপের কুখ্যাত বন্দিশালায়। কারাগারসহ সেই দ্বীপ এখন জাতীয় জাদুঘর। বছর কয়েক আগে দেখতে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি সরাফ আহমেদ। ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন সামনে রেখে পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সেই অভিজ্ঞতা।

রোবেন দ্বীপে নেলসন ম্যান্ডেলার বন্দিশালার প্রবেশপথ
ছবি: ইউনেসকো

কেপটাউনের নেলসন ম্যান্ডেলা গেটওয়ে পোতাশ্রয় থেকে ফেরি ছাড়ল। গন্তব্য রোবেন দ্বীপ। দ্রুতগামী ফেরিটিতে আমার মতো অনেক পর্যটক। আলাপ আর বেশভূষায় বোঝা যাচ্ছে নানা দেশ থেকে এসেছেন তাঁরা। আটলান্টিকের নীল ঢেউ ভেদ করে সদর্পে এগিয়ে চলেছে ফেরি। সবার অধীর অপেক্ষা কখন দৃষ্টিগোচর হয় রোবেন দ্বীপের কাঁটাতারে ঘেরা প্রান্তর। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না, দ্রুতই দৃষ্টিসীমায় চলে এল রোবেন দ্বীপ। পৌঁছাতে লাগল ৪০ মিনিটের মতো। সামনেই কারাগারের দেয়ালে নীল রঙের বিশাল ব্যানারের ওপরে লেখা ‘ফ্রিডম ক্যান নট বি ম্যানাকলড (স্বাধীনতাকে হাতকড়া পরানো যায় না)’! লেখাটার নিচে নেলসন ম্যান্ডেলাসহ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য নেতাদের ছবি।

খানিকটা এগোতেই কারাগারের মূল ফটক। সেখান দিয়ে তাকালে দূরে কাঁটাতারের বেড়া দেখা যায়। ফটক পেরিয়ে আমাদের বাসে উঠতে হলো। প্রায় সাড়ে পাঁচ বর্গকিলোমিটারের জায়গাটি কম সময়ে হেঁটে দেখা সম্ভব নয় বলেই এই বাসের ব্যবস্থা। বাসে গাইড হিসেবে যিনি আছেন, তাঁর নাম আপকে মালাঙ্গুর। ক্রিম কালারের প্যান্ট, নীল-সাদা ডোরাকাটা গেঞ্জি আর মাথায় কালো টুপি পরেছেন। তরুণ বয়সে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সামরিক শাখার গোপন গেরিলা তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব এই মানুষটা। নিজেও একসময় এই দ্বীপে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। আলাপে আলাপে আরও জানলাম, শুধু মালাঙ্গুরই নন, দ্বীপের বেশির ভাগ গাইডই একসময় ছিলেন রাজবন্দী। অফিশিয়াল ভাষ্য ছাড়াও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ইতিহাসের কালো দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যান তাঁরা।

বন্দিশালায় এই বিছানাহীন কক্ষে ম্যান্ডেলা ১৮ বছর অন্তরীণ ছিলেন।
ছবি: লেখক

আটলান্টিকের তীর ধরে বাসটি এগিয়ে যেতে থাকে। প্রথমেই বেশ বড় একটি কবরস্থান। আমরা অনেকেই বাস থেকে নেমে ছবি তুলি। মালাঙ্গুর জানালেন, অনেক আগে কুষ্ঠরোগীদের রোবেনে দ্বীপান্তরিত করা হতো। তারা মারা গেলে এখানেই সমাধিস্থ করা হতো। রাজনৈতিক বন্দীদের অনেককেই দ্বীপের চুনাপাথর খনিতে খাটানো হতো। প্রখর তাপে সেই ধকল অনেকে সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন।

সাদা গারদ

দ্বীপজুড়েই ছোট ছোট অনেক কারাগার। বেশির ভাগের দেয়াল কালো স্লেট পাথরে মোড়া। সবশেষে বি ব্লকের ৫ নম্বর সেলে এসে থামে বাস। এখানেই জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন ম্যান্ডেলা।

ব্লক বি–তে প্রবেশের আগে আমাদের লম্বা একটা হলঘরে নিয়ে যায় গাইড। ঘরটির চার দেয়াল লাগোয়া বেঞ্চ পাতা, সেগুলোতে আমাদের বসতে বলে মালাঙ্গুর। ঘরটিতে কয়েকটি দোতলা ধাতব খাট রয়েছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাইড বলতে থাকেন বন্দীদের দৈনন্দিন কারাজীবনের কথা। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে সেল পরিষ্কার করতে হতো। ছয়টায় নাশতা করে সাতটা থেকে বেলা এগারোটা পর্যন্ত চুনাপাথরখনিতে কাজ। এরপর দুপুরের খাবার ও বিশ্রাম। দুপুর ও সন্ধ্যার মধ্যকালে বন্দীরা নিজেদের ব্লকে হাঁটাহাঁটি করতে পারতেন, কেউবা করতেন সবজিবাগান। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে সব বন্দীকে সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

বন্দিশালার ঘটনা বর্ণনা করছেন জাদুঘরের একজন কর্মী
ছবি: লেখক

হলঘর থেকে বের হয়ে আমরা একটি করিডরের দিকে এগিয়ে যাই। করিডরের দুই পাশে কুঠুরির মতো ছোট ছোট ঘর। অবশেষে আমরা ম্যান্ডেলার সেলের সামনে দাঁড়াই। প্রায় চার বর্গমিটারের ঘর। কোনো খাট বা চৌকি নেই। সাদা রঙের গারদ। ছোট কাঠের টেবিলের ওপর অ্যালুমিনিয়ামের একটি করে বাটি, প্লেট ও চামচ; ছোট একটি ওয়ার্ডরোব, টিনের লাল ঢাকনিযুক্ত আবর্জনা ফেলার বালতি। ঘুমানোর জন্য মাদুর আর একটি কম্বল।

সবাই ছোট কক্ষটির ভেতরে গিয়ে ছবি তুলতে থাকে। আমিও তুলি। গাইড জানালেন, ১৯৯৮ সালে এই ঘরটিতে এসে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।

বন্দিশালার দেয়ালে নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অন্য মুক্তিসংগ্রামীদের ছবি
ছবি: লেখক

ইতিহাসের পাতায়

মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম হয়েও দীর্ঘদিন দমননীতি চালিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে কবজা করে রেখেছিল শ্বেতাঙ্গরা। এই বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াইয়ে নেমেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। একপর্যায়ে তাঁর বিরুদ্ধে ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্র’–এর অভিযোগ আনেন শাসকেরা। গ্রেপ্তার করে তাঁকে জেলে পোরে। প্রহসনের বিচারে ১৯৬৪ সালের ১ জুন তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শুরু হয় রোবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলার দীর্ঘ জেলজীবন।

রোবেন দ্বীপের ঠান্ডা ভেজা বাতাস আর কারাগারের স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে দীর্ঘ সময় থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন ম্যান্ডেলা। ১৯৮২ সালে তাঁকে কেপটাউনের পোলসমুর কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। তত দিনে কেটে গেছে ১৮ বছর। এ সময় বিশ্বজুড়েই জোরদার হতে থাকে ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবি। শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হয় দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার। কিন্তু দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন ম্যান্ডেলা। পরে ১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার কথা জানান দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক। ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান ম্যান্ডেলা। পরদিনই কেপটাউনে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে অংশ নিয়ে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে চলা আমাদের সংগ্রাম এখন শেষ পর্যায়ে। আমরা স্বপ্ন দেখছি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের, যেখানে সম–অধিকার নিয়ে সবাই বাস করবে। বর্ণবাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

রোবেন দ্বীপ থেকে ফেরার পথে মনে হলো ম্যান্ডেলার সেই কথা আজও প্রাসঙ্গিক।