কবরের মতো বরফ খুঁড়ে সেখানেই থাকতে হয় রাতভর
সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন সপ্তদশ পর্ব
জাহাজের নোটিশ বোর্ডে একটা নোটিশ সেঁটে দেওয়া হয়েছে। সেখানে লেখা—যাঁরা যাঁরা ক্যাম্পিং করবেন, তাঁরা যেন জাহাজের তিনতলার লাউঞ্জ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করেন। ক্যাম্পিং হবে পোর্টাল পয়েন্টে। আমাদের চার বান্ধবীর একজন সাসকিয়া ছুটল লাউঞ্জের দিকে। জাহাজের অভিযাত্রী দলের মধ্যে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে সবার মধ্যে অতিপরিচিত হয়ে গেছেন আমেরিকার লাইসা। তাঁর বয়স আমার চোখের অনুমানে সত্তরের ওপর হবে। খর্বকায় মানুষটার চুল ফৌজি অফিসারের মতো ছোট। লাইসা হাঁটেন না, যেন নাচেন। সর্বক্ষণ জাহাজে এমনভাবে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটেন, যেন সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে নাচছেন। ভদ্রমহিলা একাই ঘুরতে এসেছেন, তিনি সবখানে সবার সামনে থাকেন। সহযাত্রীদের বিপুল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সিক্ত। তিনিও ছুটে চলছেন লাউঞ্জের দিকে। তাঁর যাওয়া দেখে আমি কিছুটা আতঙ্কিত! এই নারী সারা রাত বরফের গর্তে থাকবে!
সাসকিয়া জিনিসপত্র বুঝে নিয়েছে। তাকে দেওয়া হয়েছে ম্যাট্রেস, স্লিপিং ব্যাগ আর বরফ খোঁড়ার জন্য লম্বা হাতলের বেলচা। ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীদের বিকেলেই রাতের খাবার শেষ করে পোর্টাল পয়েন্টে পৌঁছাতে হবে। ক্যাম্পিংয়ের জিনিসপত্র নিজেদেরই বহন করতে হবে। বরফের মধ্যে যে গর্তে সারা রাত শুয়ে থাকতে হবে, সেটা খোঁড়ার কাজটিও নিজেকেই করতে হবে। কোনো রকম খানাখাদ্য সেখানে নেওয়া যাবে না।
সাসকিয়াকে বললাম, ‘তুমি আগাও, আমরা আসছি একটু পরে, গর্ত করার কাজে তোমাকে সাহায্য করব।’
এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখা ভালো, একটি অভিযাত্রী দলের অল্প কিছুসংখ্যক অভিযাত্রী ক্যাম্পিং করতে পারেন। তাই যাঁরা সবার আগে অ্যান্টার্কটিকা ভ্রমণ নিশ্চিত করেন, তাঁরাই সেই সুযোগ পান। জনা বিশেক সৌভাগ্যবান আগে পৌঁছে গেলেন। আমরা যেহেতু ক্যাম্পিং করব না, তাই আমরা গেলাম দ্বিতীয় দফায়। জোডিয়াক আমাদের নামিয়ে দিল একটি সুউচ্চ শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের পাদদেশে। গাইড নির্দেশ দিলেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই হবে, না উঠে ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া আমরা যেখান দিয়ে হাইকিং করে উঠব, রাতে জাহাজে ফেরার সময় ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরব। তাই পদব্রজে চলো সবাই। আবার সাবধান করল এই বলে, এখানে হাইকিং করা বেশ মুশকিল। প্রত্যেকে যেন দুইটা হাইকিং পোল সঙ্গে নিই। ভাবলাম গতকাল যেহেতু হাইকিং করেছি আমার জন্য এ আর তেমন একটা মুশকিলের হবে না । যা ভেবেছি পরিস্থিতি তার বিপরীত। পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পথ বেশ দীর্ঘ। ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীরা ক্যাম্পিং সরঞ্জাম নিয়ে উঠল কীভাবে! তাড়াহুড়া করতে গিয়ে মাঝপথে পা মচকে পড়ে গেলাম। অপরিচিত এক অভিযাত্রী টেনে তুললেন। এবার একটু সিরিয়াস হলাম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসছে। আমরা অভিযাত্রী দল হাঁটছি। আসলে পাহাড় বাইছি। অ্যান্টার্কটিকা যদি হয় হিমবাহের মরুভূমি, তবে আমরা এই মরুভূমির বেদুইন।
সব ক্লান্তি নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে গেল যখন চূড়ায় উঠলাম। পাহাড়ে বরফের পুরুত্ব অনেক বেশি। কী আশ্চর্য! এই পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশ সম্পূর্ণ সমতল। ক্যাম্পিংয়ে অংশগ্রহণকারীরা গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত। তাঁদের হাতে বেলচা। প্রত্যেকের গর্ত আয়তাকার। মেথিয়াস যে গর্তটা খুঁড়ছে সেটা বেশ বড়, দুজন শোয়ার মতো।
তুমি এত বড় গর্ত খুঁড়ছ কেন?
‘আরে আমার সঙ্গে তো আমার গার্লফ্রেন্ডও ঘুমাবে, আমরা দুজন।’
কী সর্বনাশ! আমি এত দিন তাদের স্বামী-স্ত্রী ভেবেছি। আমাদের বাঙালিদের এই এক বাজে স্বভাব। নারী–পুরুষ একসঙ্গে দেখলেই স্বামী-স্ত্রী ভাবতে শুরু করি। দুনিয়ায় যে এর বাইরেও সম্পর্ক হয়, ঠাহর করতে পারি না।
শিরদাঁড়া টানটান করে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্বাস নিচ্ছি। সম্পূর্ণ আকাশ মাথা নুইয়ে আমায় দেখছে। আকাশের এত কাছে আমি আগে কখনো যাইনি। সূর্য ডুবছে। দিগন্তে আবির। চারদিকের সফেদ বরফের ওপর আগুনের প্রলেপ। এই প্রথম মনে হলো পুরো অ্যান্টার্কটিকা দেখছি।
এখন আমার আকাশ দেখার সময় নয়। সাসকিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে গর্ত খুঁড়তে সাহায্য করতে হবে। আমার দুই হাতে দুটি হাইকিং পোল। শরীরের সমস্ত ভর তাদের ওপর দিয়ে হাঁটছি আর সাসকিয়াকে খুঁজছি। তাকে পেতে বেশি সময় অবশ্য লাগেনি। আমি পৌঁছানোর আগেই তার কাছে পৌঁছে গেছে সাঈদা আর ক্যারোলিন। তাদের থামিয়ে নিজেই হাত লাগালাম। বেশ শক্তি খাটাতে হচ্ছে। সহজ কাজ নয়। নিচের দিকের বরফ বেশ শক্ত। আঘাত করতে হচ্ছে জোরে। সাসকিয়া বেশ চিকনি চামেলী। এই গর্তের প্রস্থ খুব বেশি না করলেও চলে। কাজটি আমার জন্য একেবারেই নতুন। তবু এটাকে কর্তব্য ভাবছি। আনন্দ পাচ্ছি এই ভেবে যে সাসকিয়ার ‘ক্যাম্পিং কবর’–এ আমরা বাকি তিন বন্ধু কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। ক্যাম্পিংয়ের অভিজ্ঞতা নেব।
ক্যাম্পিং মানেই তাঁবু টাঙিয়ে রাত্রিযাপন, কিন্তু অ্যান্টার্কটিকায় বাতাসের গতিবেগ বেশি, তাই তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্পিং করা যায় না। এখানে রীতিমতো কবরে শুয়ে থাকার মতো অভিজ্ঞতা হয়।
সাসকিয়াকে তোশক যেটা দিয়েছে, সেটি গর্তে বিছিয়ে দিলাম। তোশকের রং নিকষ কালো। সরবরাহকৃত স্লিপিং ব্যাগ টকটকে লাল। সিঁদুরের মতো। ব্যাগগুলো উষ্ণ আর মনোমুগ্ধকর। এবার সাসকিয়া স্লিপিং ব্যাগে তার পুরো শরীর ঢুকিয়ে দেবে, শ্বাস নেওয়ার জন্য নাকটা শুধু বাইরে থাকবে। কিন্তু সাসকিয়া সেটা না করে আমাদের বলল, ‘এখন তোমরা শুয়ে থাকতে পারো যতক্ষণ খুশি, আমার জন্য তো সারা রাত রইল।’ ধপাস করে শুয়ে পড়লাম আমি আর সাঈদা।
সূর্য বিদায় নিয়েছে। আকাশে কোনো আবিরের চিহ্ন নেই। আকাশ এখন তারায় ভরা। চাঁদ স্পষ্ট নয়। এটি একরকম মরুভূমির অভিজ্ঞতা নেওয়ার মতো। গাইড বলছিলেন, যদি হিমবাহের কারণে বাতাসের গতি তীব্র হয় তবে ক্যাম্পিং বাতিল করতে হয়। তবে আজ আবহাওয়ার তেমন কোনো পূর্বাভাস নেই। আমাদের সময় শেষ। আমরা জাহাজে ফিরে যাব। রয়ে যাবে সাসকিয়ারা।
আরও পড়ুন
১. অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা কীভাবে শুরু হয়?
২. ৭২ জন ‘গোপাল ভাঁড়ের’ সঙ্গে অ্যান্টার্কটিকা যাত্রা
৩. ‘তোমরা আমাকে যেকোনো সময় হাগ করতে পারো’
৪. আকাশে এখনো কোনো অ্যালবাট্রস পাখির দেখা মেলেনি
৫. অ্যান্টার্কটিকার জাহাজে খেতে দিল রুটি আর বেগুন ভাজি
৬. অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
৭. সাগরের পানিকে কেন বলা হতো কালাপানি
৮. অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে জাহাজ থেকে অভিযাত্রীদের যেভাবে নামতে হয়
৯. অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছে অভিযাত্রীদের মধ্যে আমিই প্রথম জাহাজ থেকে নামলাম
১০. দ্বীপটিতে পেঙ্গুইন ছাড়া আর কিছু নেই
১১. তিনটি তিমি আমাদের ঘিরে ধরল
১২. অ্যান্টার্কটিকায় যেভাবে উদ্যাপিত হলো জন্মদিন
১৩. পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের ডাকঘর থেকে দুই ছেলেকে চিঠি পাঠালাম
১৪. মাসে মাত্র ১০০ শব্দের বার্তা পাঠাতে পারতেন তাঁরা, এতেই হতো যোগাযোগ
১৫. নদীপারের মেয়ে আমি কিন্তু বইঠা হাতে নিয়েছি আজই প্রথম
১৬. রূপপুরে কাজ করতে আসবে রাশিয়ার ওলগা, তাঁর সঙ্গে দেখা অ্যান্টার্কটিকায়