বাবরদের ক্লাবটির নাম কেন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স
বাবর আলীর এভারেস্ট ও লোৎসে অভিযানের সময় বারবার শোনা গেছে ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’-এর নাম। চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ-বিষয়ক ক্লাবটির সাংগঠনিক সম্পাদক বাবর। ক্লাবটির গোড়াপত্তনের গল্প শোনাচ্ছেন এর প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান
স্যাঁতসেঁতে গুমোট পরিবেশ। গুহার ভেতর থেকে ভেসে আসছে বোঁটকা গন্ধ। ডানা ঝাপটে আসা-যাওয়া করছে কিছু নিশাচর। এক কোণে গুহার দেয়ালে উল্টো হয়ে ঝুলছে কয়েকটা। অনাহূত অতিথিদের ড্যাবড্যাব করে দেখছে। রেগে আছে ওরা? থাকলে অবশ্য ওদের দোষ দেওয়া চলে না। নিজেদের আস্তানায় অনাহূত অতিথি কারোরই ভালো লাগার কথা না। দুখানা তাঁবু গেড়ে গুহামুখে বসে আছে কয়েকজন দুপেয়ে, এ তো রীতিমতো উপদ্রব বাদুড়ের দলের কাছে।
২০১৪ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের আলীকদমের ওই গুহামুখে সে রাতে বসে ছিলাম আমরা। বাদুড়ের ওই গুহা দখল করতে নয়, বরং ওদের নিবাসে আমাদের গোত্রের প্রাণীদের বানানো আবর্জনার ভাগাড় পরিষ্কার করতে। বাবর আলীর ডাকেই মূলত ওই রাত্রিবাস। বেশ জমানো আড্ডা চলছিল। কিছুদিন আগে সাকা হাফং পাহাড়ে চড়তে গিয়ে আমাদের পরিচয়। সবাই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলছে। হিমালয় থেকে বান্দরবান—কিছুই বাদ গেল না। গল্পের ফাঁকেই উঠে এল চাপা হতাশা।
বাংলাদেশ থেকে এভারেস্টে পাঁচবার চড়া হয়ে গেলেও চট্টগ্রামের কেউই হিমালয়ে কোনো অভিযান করতে পারল না, এখানে নেই কোনো পর্বতারোহীদের প্ল্যাটফর্ম! অথচ প্রস্তুতি নিতে সবাই চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর নির্ভর করে। আর সেই চট্টগ্রামের তরুণদের কোনো পরামর্শ প্রয়োজন হলেই ছুটতে হয় রাজধানী! সবাই একমত হলাম যে এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। যে-ই ভাবা, সেই কাজ। মাসখানেক ধরে দফায় দফায় বৈঠক। দেবাশীষ বল ক্লাবের নাম দিল ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’, আর আমি দিলাম স্লোগান—ক্লাইম্ব হাই, ড্রিম হাইয়ার। রচিত হলো গঠনতন্ত্র। দেবাশীষকে সভাপতি এবং আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ওই বছর ৩০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’।
১০ বছর পর স্মৃতির পাতা উল্টে দেখি প্রাপ্তি নেহাত কম নয়। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে আমি, বাবর এবং আরিফ নেওয়াজ চট্টগ্রাম থেকে হিমালয় অভিযান করি। ওই অভিযানে আমরা আরোহণ করি তিনটি ট্রেকিং পিক। ২০১৬ সালে আমরা চড়ি ভারতের ইয়ানাম পর্বত। ভারতের হিমালয়ে চেমা, ফাব্রাং, সিসিকেএন, শিবা, রামজাক, দেও তিব্বা, ফ্রেন্ডশিপ পিক, কাং ইয়াৎসে-২ অভিযান করেছি আমরা। আর নেপালে কেয়ানজিন রি, সারগো রি আর সুরিয়া দিয়ে শুরু করে অভিযান করেছি টেন্ট পিক, মেরা পিক, লবুচে ইস্ট, চুলু ইস্ট, চুলু ফার-ইস্ট, আমা দাবলাম। আর অবশেষে এই বছর বাবর আলীর দুঃসাহসিক অভিযানে রচিত হলো এভারেস্ট-লোৎসে মহাকাব্য।
কখনো শুধু নিজেরাই, কখনো অন্য দলের সঙ্গে মিলে অভিযান করেছি আমরা। কোথাও সফল হয়েছি, কোথাও ব্যর্থ হয়ে শিখেছি। তবু দেখা শেষ হয়নি আমাদের শ্বেতস্বপ্ন।
শিখরে গিয়ে শিকড় ভুললে চলবে! দেশের পাহাড়েও নিয়মিত চলেছে আমাদের অভিযান। নিজেরাই পথ বানিয়ে নিজেরাই ছুটে চলি। পাহাড়ে চলতে গিয়ে পাহাড়ের মানুষদের ভালোবেসে ফেলেছি। শিক্ষা, চিকিৎসা এবং চাষাবাদে সাধ্যমতো ওদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। অনেক তরুণকে ক্লাইম্বিংয়ে হাতেখড়ি দিয়েছি। মাঝেমধ্যে বসাই অভিযাত্রীদের গল্প শোনার আসর ‘মাউন্টেন টক’, যাতে অংশ নিয়েছেন দেশে-বিদেশের বহু স্বনামধন্য পর্বতারোহী। একাধিকবার করেছি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। পর্বতারোহণের ইতিহাস এবং চলমান খবর নিজের মাতৃভাষায় জানাতে ফেসবুকে আছে আমাদের পেজ—ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
তিনবার আয়োজন করেছি ক্লাইম্বিং নিয়ে প্রতিযোগিতা ‘ক্লাইম্বাথন বাংলাদেশ’। পর্বতারোহীরা অতৃপ্ত আত্মা। তাই দড়ি চড়তে দিয়েই থামিনি আমরা। আয়োজন করেছি দৌড় প্রতিযোগিতা। সমতলে নয়, পাহাড়ে। ২০১৯ সালে আলীকদমে ১৬ কিলোমিটারের ট্রেইল রান, ২০২৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ সড়কে হিল ম্যারাথন আর ২০২৪-এ ৫২ কিলোমিটারের আলট্রা দৌড় প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আয়োজন।
আমরা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। সদস্যদের বার্ষিক চাঁদা দিয়ে কিনি পাহাড়ে চড়ার সরঞ্জাম। আর আদিবাসী গোষ্ঠীর কল্যাণে দিই বিভিন্ন আয়োজনের উদ্বৃত্ত অংশ। কোনো আয়োজনের ডাক এলেই ক্লাবের সদস্যরা রাতের পর রাত কাটিয়ে দেয় নির্ঘুম। পাহাড়ে চড়ার সূত্রে অর্জিত এই ভ্রাতৃত্বকে আমরা বলি—নাড়ির নয়, দড়ির টান। অনেকটা পথ চলেও আমরা ক্লান্ত নই। কেউ স্বপ্নপূরণে মত্ত, কেউ নিজের স্বপ্ন অন্যের চোখে রাঙাতে দেখতে। কারণ, আমাদের স্বপ্নগুলো খাড়া, আমরা স্বপ্নচারী, আমরা ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।