প্রথমবার নেপালে গিয়ে প্যারাগ্লাইডিং করেছিলাম। পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দিয়ে ৩০ মিনিট পোখারা সিটি ও ফেওয়া লেকের ওপরে ওড়ার অভিজ্ঞতাটা এখন পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। ২০২২-এ যখন আবার নেপালে গেলাম, তখন আমার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল বাঞ্জি জাম্পিং।
নেপালে বাঞ্জি করার অনেকগুলো সুযোগ আছে। আমি বেছে নিয়েছিলাম ‘গো বাঞ্জি নেপাল’। সারা বিশ্বে ওদের বাঞ্জি আছে এবং পোখারার পাশে অনেক কম বাজেটে এই সেবা নেওয়া যায়। ১০১ মিটার উঁচু টাওয়ার থেকে বাঞ্জি জাম্প করার সুযোগ দেয় ‘গো বাঞ্জি নেপাল’।
খরচের হিসাবটা একটু জানিয়ে দিই। ‘গো বাঞ্জি নেপাল’-এর অফিশিয়াল রেট হচ্ছে ছবি, ভিডিওসহ ৬ হাজার নেপালি রুপি (বাংলাদেশি টাকায় ৪০০০-৪৫০০ টাকা)। কিন্তু আপনি বিভিন্ন এজেন্ট অফিসে গিয়ে কথা বলে ৫০০-১০০০ রুপির ছাড়ের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন। ছাড় যদি না–ও পান, তারপরও এটিই নেপালে সবচেয়ে কম খরচের বাঞ্জি। আপনি যদি সেই দিনই দ্বিতীয়বার জাম্প দেন, তাহলে এবারের জন্য ৩ হাজার নেপালি রুপি। সেদিন না দিয়ে পরেরবার নেপাল বা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গো বাঞ্জিতে বাঞ্জি দিতে আপনার খরচ হবে ৪ হাজার রুপি। বিস্তারিত তথ্য ও বুকিং অপশন পেয়ে যাবেন (www.gobungynepal.com) ওয়েবসাইটে। এ ছাড়া হাই গ্রাউন্ড অ্যাডভেঞ্চার ও দুনিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাঞ্জি ‘দ্য ক্লিফ’ থেকে বাঞ্জি দিতে পারেন পোখারায়।
বুকিংয়ের সময় আপনি কোন সময় ঝাঁপ দিতে চান, ঠিক করে নিতে পারবেন। আমি সকালের বুকিং করেছিলাম। যেহেতু বাঞ্জি জাম্প দেব, তাই সকালে হালকা খেয়েছি। সকাল ৯টার দিকে গো বাঞ্জি নেপালের গাড়ি চলে এল। গাড়িতে দুই ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে পরিচয় হলো। ওদেরও প্রথম বাঞ্জি। সবাই খুব দুরুদুরু। কিন্তু অনেক বেশি এক্সাইটেডও ছিলাম। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে গো বাঞ্জি নেপালের স্পটে পৌঁছে গেলাম। স্থানটি সমতল হলেও পাশেই যে নদী, তা কয়েক শ মিটার নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় থেকে মাঝ পর্যন্ত বিশাল একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এখানে মাঝবরাবর একটি ক্লিফ তৈরি করা আছে, যেখান থেকে লাফ দিতে হয়।
ওখানে পৌঁছানোর পর নানা তথ্য দিয়ে নিবন্ধন শেষে সম্মতিপত্রে সই করতে হয়। এরপর একটি লকার ও টি–শার্ট দেওয়া হয়। ঘড়ি, মুঠোফোন, মানিব্যাগসহ পকেটের সবকিছু রাখার জন্য লকার। প্রত্যেকের ওজন মেপে এরপর শুরু হয় প্রশিক্ষণ। কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, লাফ কীভাবে দিতে হবে, লাফ দেওয়ার পর কী করতে হবে—একটি পুতুলের সাহায্যে সব ধরনের গাইডলাইন দেওয়া হয়।
ফটোগ্রাফি শেষে আমাদের নিরাপত্তার জন্য দরকারি সবকিছু পরানো হয়। একটি ক্লিফের সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে টাওয়ারের মতো রাস্তাটায় ওঠানো হয়। টাওয়ারটির নিচে কয়েক শ মিটারের খাদ, স্বাভাবিকভাবেই ভয় লাগে। ভারতীয় দুজন, নেপালি একজন ও আমি ওই সময়ে বাঞ্জির জন্য গেলাম। ভারতীয় মেয়েটি অনেক ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু অন্যরা স্বাভাবিক ছিল। শুরুতেই আমাকে ডাকা হলো। আগেই শরীরের সঙ্গে সিকিউরিটির যে কভারটি পরানো হয়েছিল, তার সঙ্গে কয়েকটি বাকল এবং বাঁ হাতের সঙ্গে একটি অ্যাকশন ক্যামেরা যুক্ত করে দেওয়া হলো। এরপর ক্লিফের একদম সামনে নিয়ে গিয়ে ক্যামেরায় নিজের অনুভূতি বর্ণনা করতে বলা হলো।
পাখির ডানার মতো দুই হাত দুই পাশে রেখে আমাকে লাফ দিতে বলল। পুরো এক্সাইটমেন্ট নিয়ে লাফ দিলাম! পেছনে ক্লিপ দিয়ে লম্বা দড়ি লাগানো থাকলেও শুরুর সময়ে সেটি অনুভব করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল উঁচু কোনো ছাদ থেকে লাফ দিয়েছি এবং খাদের নিচে হয়তো পড়ে যাব। ভয়ে চোখে শর্ষে ফুল দেখছিলাম! মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে ভয়, উত্তেজনা, দিশাহারা, অনুতাপসহ কত কিছু যে অনুভব করেছি, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এরপর যখন দড়ির টান লেগে হাওয়ার মধ্যে পাখির মতো উড়তে থাকলাম, তার যে ভালো লাগা, ভাষায় সেটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দড়ির দোল কমলে আমাকে যে ক্লিফে টান দিতে বলা হয়েছিল, সেটি টান দিলাম। ক্লিফটি খুলে গেলে আমি সোজা হয়ে গেলাম। লাফের সময় মাথা নিচে থাকে। এই ক্লিফটি খুলে দিলে শূন্যের মধ্যে পাখির মতো ওড়ার অনুভূতি পাওয়া যায়!
দুই মিনিট পর ওপর থেকে একটি দড়ি নেমে এল। দড়িটা ধরে বুকের ক্লিপের সঙ্গে লাগিয়ে নিলাম। এরপর আমাকে ধীরে ধীরে ওপরে টেনে তোলা হলো।
দুটি ক্যামেরা দিয়ে পুরো সময়টির ছবি ও ভিডিও করা হয়। অন্যদের লাফ কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে অফিসে ফিরে এসে ছবি ও ভিডিওগুলো তখনই নিজের মুঠোফোনে নিয়ে নিলাম। ওরা সাধারণত মেইলে পাঠিয়ে দেয়। তবে আপনি চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে নিতে পারেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর আপনাকে ওদের গাড়িতে করে পুনরায় হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হয়।