কর্ডোবার গাছে ঝুলে থাকা কমলা কেন কেউ খায় না

মুসলিম স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রধান শহর কর্ডোবাছবি: লেখক

কর্ডোবায় যাওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকে ছিল না। যাওয়ার আগের রাতে হঠাৎই ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম। ভোরে মাদ্রিদের রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। যতবারই ট্রেনে কোথাও যাওয়ার কথা থাকে, মনে হয় ট্রেন চলে যাবে, কপালজোরে এ পর্যন্ত একবারও অবশ্য এ রকম ঘটনা হয়নি। এবারও হলো না। আরামেই কর্ডোবায় পৌঁছালাম।

কর্ডোবার পুরো শহরজুড়ে সুন্দর করে সাজানো কমলাগাছ
ছবি: লেখক

স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি নিলাম, উদ্দেশ্য কর্ডোবার মসজিদ–ক্যাথেড্রাল দেখা। ট্যাক্সি রাস্তায় নামতেই অবাক হলাম। রাস্তার যে দিকেই তাকাই, সুন্দর করে সাজানো কমলাগাছ দেখতে পাই। অনেক গাছে আবার পাতার চেয়ে কমলা বেশি। কমলার চিন্তা করতে করতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এটাকে স্থানীয় লোকজন স্প্যানিশ ভাষায় বলে ‘মেজকুইটা-ক্যাথেড্রাল’। আরেক নাম হলো ‘দ্য গ্রেট মস্ক অব কর্ডোবা’। ৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে উমায়েদ শাসক আব-দাল রহমান প্রথম এটি তৈরির কাজ শুরু করেন। আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনামলে মসজিদটি বেশ কয়েকবার সম্প্রসারণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয় আবদুর রহমান, দ্বিতীয় আল-হাকাম ও আল-মনসুর সময়ে। প্রতিটি সম্প্রসারণেই মসজিদের সৌন্দর্য, আকার ও ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

বিরাট এলাকাজুড়ে এই স্থাপনা। পুরোটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে খোলা মাঠ আর কমলা, খেজুরসহ নানা ফলের বাগান। চোখে পড়ে বেশ উঁচু মিনার। স্পেন ও উত্তর আফ্রিকার প্রায় সব মসজিদেরই এ ধরনের মিনার থাকে। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতরে ঢুকে অলংকরণের কাজ আর আকার দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অনেক ইসলামিক ক্যালিগ্রাফি।

মেজকুইটা-ক্যাথেড্রালের খিলানগুলো লাল ইট আর সাদা পাথরে পর্যায়ক্রমে সাজানো
ছবি: লেখক

জ্যামিতিক ও শৈল্পিক নকশার জন্য মেজকুইটার স্থাপত্য বিখ্যাত, যা রোমান, গথিক, বাইজেন্টাইন ও উমায়েদ স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণ। এ রকম স্থাপত্যের মসজিদ খুব বেশি নেই। মোজাইক ও সোনার কারুকাজে সাজানো মিহরাব। কলামগুলো এমনভাবে সাজানো যে তাকালে মনে হয়, কলামগুলোর যেন শেষ নেই। খিলানগুলো লাল ইট আর সাদা পাথরে পর্যায়ক্রমে সাজানো, আকর্ষণীয় বেশ। বাইরের দিকের দেয়াল ও গেটগুলোতে বেশ ভারী কারুকাজ।

মেজকুইটা-ক্যাথেড্রালের বাইরের অংশ
ছবি: লেখক

এখান থেকে বের হয়ে গুয়াদালকুইভির নদীর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। নদীর সামনে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে বিস্তৃত এক রোমান সেতু। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে তৈরি এই সেতু এখনো বেশ শক্তপোক্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার এটি মেরামত করা হয়েছে। প্রায় দুই হাজার বছর পুরোনো সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। এটি রোমানদের ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতার একটি প্রমাণ। ব্রিজের এক পাশে টরে দে লা ক্যালাহোরা টাওয়ার। এই টাওয়ার মূলত প্রতিরক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল, তবে এখন এটি জাদুঘর।

ব্রিজ থেকে একটু সামনে হেঁটে গেলেই আলকাজার দে লস রেয়েস ক্রিস্টিয়ানোস। কর্ডোবার মুসলিম শাসন আমলে এটি দুর্গ হিসেবে তৈরি করা হয়। পরে কর্ডোবার রাজার বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর বিভিন্ন কামরা, বারান্দা ঘুরে দেখলাম। এই প্রাসাদের মিনার থেকে কর্ডোবা শহরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়, যা বেশ মনোরম। এই প্রাসাদের দুই–তৃতীয়াংশে বাগান। বাগানে ঝরনা, পুকুর।

দ্য গ্রেট মস্ক অব কর্ডোবা
ছবি: লেখক

পুকুরে নানা রকম মাছ আর বাগানে অনেক রকম ফলের গাছ। আবারও লক্ষ করলাম কমলার আধিক্য। মনে মনে সংকল্প করলাম, কমলার এই ছড়াছড়ির কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এই প্রাসাদ সম্পর্কে একটি তথ্য জানতে পারলাম। এখানে থেকেই কলম্বাস এশিয়ায় যাওয়ার পথ খুঁজতে বের হওয়ার জন্য রাজা ফার্দিনান্দ আর রানি ইসাবেলা থেকে অনুমতি ও অর্থ সংগ্রহ করেন। ভুলক্রমে এশিয়ায় না গিয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসে।

গুয়াদালকুইভির নদী
ছবি: লেখক

প্রাসাদ দেখা শেষ করে পুরোনো শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। এখনো অনেক ঘরবাড়ি সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। বাড়িগুলো আকারে বেশি বড় নয়। প্রায় সব বাড়ির মাঝখানে খোলা ছাদ। গরমের সময় বাতাস এসে বাসা ঠান্ডা রাখে আর ঠান্ডার সময় ওরা ছাদ ঢেকে দেয়, যাতে বাসা গরম থাকে। এ রকম একটি বাসাতেই আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। এটি একটি সিরীয় রেস্তোরাঁ। সিরীয় কাবাবের সঙ্গে স্যাফরন ভাত আর সালাদ। খাবার শেষে বের হলাম চায়ের দোকানের সন্ধানে। মাথায় কমলার বিষয়টি এখনো ঘুরছে আর সহ্য না করতে পেরে একটা গাছ থেকে কমলা পেরেই ফেললাম। বেশ বড় কমলা, খোসা ছাড়িয়ে দেখা গেল রসালোও অনেক।

মুখে দেওয়ামাত্র কমলার রহস্য পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। এই কমলা খুবই তিতা আর কষযুক্ত। মনে মনে ইচ্ছা ছিল, ট্রেনে বসে খাওয়ার জন্য যাওয়ার সময় কিছু কমলা নিয়ে যাব, সে আশা পূরণ হলো না। স্টেশনে ফেরার সময় ট্যাক্সিচালককে জিজ্ঞেস করলাম এই কমলার কথা। সে জানাল, এই কমলাগাছ শুধু শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য লাগানো হয়, খাওয়ার জন্য নয়।

মুসলিম স্বর্ণযুগের অন্যতম প্রধান শহর দেখা শেষ করে মাদ্রিদের ট্রেনে উঠে বসলাম।