ডুয়ার্সের অভয়ারণ্যে একদিন
কলকাতা থেকে ট্রেনযোগে নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে আমরা পৌঁছলাম ডুয়ার্সের লাটাগুড়ি। আমাদের হোটেলের নাম ‘দ্য ফরেস্ট’। হোটেলের কাছেই বন বিভাগের দপ্তর। পরদিন সকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফি দিয়ে সেখান থেকে ৬ জনের নামে পাস সংগ্রহ করে খোলা জিপে উঠে পড়ি। তখনো সূর্য ওঠেনি। প্রচণ্ড ঠান্ডা ঠেকাতে সোয়েটারের ওপর চাদর জড়িয়ে নিয়েছি। আমাদের গন্তব্য গরুমারা অভয়ারণ্য।
খোলা জিপে ড্রাইভারের পাশে গাইড। আর পেছনে দুই দিকে ৬টি আসন। ৬টি আসনের ভাড়া ১ হাজার ৩২০ রুপি। গাইডের ফি ৩৫০ রুপি। ইচ্ছা করলে গাড়িতে দাঁড়িয়েও করতে পারেন জঙ্গল সাফারি। প্রধান সড়ক থেকে জঙ্গলে ঢোকার সময় গাইড জানালেন, দুই দিকে খেয়াল রাখুন, আপনাদের চোখে কোনো জীবজন্তু পড়ে কি না।
অচিরেই গহিন জঙ্গলে ঢুকে পড়ে জিপ। হঠাৎ গাইড বললেন, বাঁ দিকে তাকান। আমাদের জিপ স্লো হয়ে যায়। আবছা অন্ধকারে দেখি, তিনটি বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক বাইসন। শুনেছি, এই জঙ্গলে লেপার্ডও আছে, আর আছে হাতি ও হরিণ।
ডুয়ার্স অর্থ দুয়ার বা দরজা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার সীমান্তের ৪ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে পাহাড়-নদী নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ডুয়ার্স। ডুয়ার্সের কালো চিনির চা, হ্যামিলটনের কাঠ আর হাসিমারার আনারস বিখ্যাত। রয়েছে ১৫২টি চা–বাগান, ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত বনভূমি, যেখানে হাজারো পাখি আর বন্য প্রাণীর বাস। ডুয়ার্সে মেলে ৭২০ প্রজাতির পাখি। ডুয়ার্সের সীমান্তলাগোয়া ভুটান। এই ডুয়ার্সের বুক চিরে বয়ে গেছে তিস্তা আর সংকোশ নদী। বয়ে চলেছে তোরসা, রায়ডাক, জলঢাকা, কালজানি, মূর্তি, ডায়না, জয়ন্তীর মতো ছোট ছোট পাহাড়ি নদী। ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে আছে হাতি, বাইসন, হরিণ, ময়ূর, বনটিয়া, বনমোরগ, তিতির, হরিয়ালসহ আরও অনেক জীবজন্তু। আর আছে লেপার্ড। এই ডুয়ার্সেরই অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ গরুমারা অভয়ারণ্য। প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এই অভয়ারণ্য। গরুমারা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম জাতীয় উদ্যান। জঙ্গল সাফারিতে এ–জাতীয় উদ্যান ঘুরতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। লাটাগুড়ির ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার থেকে পাস নিয়ে খোলা জিপে ঘুরতে হয় অভয়ারণ্য।
কিছুদূর এগোনোর পর গাইড আবার বললেন, এবার ডান দিকে তাকান। আমরা তাকালাম। দেখলাম, সকালের আলো ফোটার আগেকার অন্ধকারে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল একটা হরিণ। আমরা চলছি। কিছুটা ভয়ও লাগছে, যদি কোনো জন্তু এসে পড়ে! কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ একটি ময়ূর আমাদের জিপের সামনে উড়ে এসে পড়ল। বিশাল পুচ্ছ। জিপ থামল। ময়ূরটি ধীরে ধীরে জঙ্গলের রাস্তা ছেড়ে ঢুকে গেল গভীর জঙ্গলে। চোখে পড়ল বহু পাখি। এপাশ-ওপাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছুদূর চলার পর দেখি চারটি হাতি। গাইড বললেন, হাতি চারটি পোষা। জঙ্গলে মালামাল বহন করে।
জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মূর্তি। নদীতে সামান্য পানি। চর পড়ে গেছে। গাইড জানালেন, ওই পারে যে পাহাড় দেখছেন, ওটা ভুটান।
জঙ্গলের এক দিকের শেষ প্রান্ত মেদলাবাড়ি ওয়াচ টাওয়ারের কাছে এসে দাঁড়াল আমাদের জিপ। পাশেই বন দপ্তরের অফিস। জিপ থেকে নেমে মহিষের গাড়িতে করে এবার যেতে হবে আধা কিলোমিটার দূরের ওয়াচ টাওয়ারের কাছে।
গাইড জানালেন, গরুর গাড়িতে একসঙ্গে ১০ জন পর্যটক নিতে পারে না, তাই মহিষের গাড়ি। মহিষ ১০ জনকে নিয়ে চলতে পারে। যাত্রীপ্রতি মহিষের গাড়ির ভাড়া ৬০ রুপি। এ রাস্তাটুকু খোলা জিপে যাওয়া গেলেও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে এই মহিষের গাড়ি চালু করেছে এখানকার উপজাতিরা। এটা এলাকার একধরনের ব্যবসা।
মেদলাবাড়ি ওয়াচ টাওয়ারের সামনে মহিষের গাড়ি থেকে আমরা নামলাম। এ ধরনের আরও তিনটি ওয়াচ টাওয়ার এই অভয়ারণ্যে রয়েছে। সেগুলো হলো যাত্রাপ্রসাদ, চুকচুকি ও চন্দ্রচূড়। আমরা তিনতলা উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম। কাছেই দেখা যাচ্ছে মূর্তি নদী, অদূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা, আরও দূরে ভুটান। গাইড জানালেন, ওই যে ওপারে দেখছেন ছোট্ট জঙ্গল, ওই জঙ্গল থেকে এই মূর্তি নদীতে মাঝেমধ্যে আসে একশৃঙ্গী গন্ডার। কিন্তু সেদিন আমাদের ভাগ্যে গন্ডার দর্শন ছিল না। মেঘের কারণে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার দেখাও মেলেনি। শুধু আবছা দেখলাম, দূরে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর ভুটানের পাহাড়।
এই জঙ্গলে আছে একটি ঐতিহাসিক শিবমন্দির। নাম মহাকাল মন্দির। খোলা জায়গায় মন্দির। কথিত আছে, এ জায়গায় বারবার মন্দির গড়তে গেলে হাতি এসে ভেঙে দিয়ে যায়। তাই এখন ফাঁকা জায়গায় পুজো হয়। জঙ্গলে হাতি চলাচলের জায়গায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে বন বিভাগ, যাতে মানুষ সতর্ক হয়ে চলতে পারে।