হিমালয়ে হিমবাহে ৪
পর্বতারোহীরা কেন থামেন নামচে বাজার
৬৩ বছর বয়সে এসে হিমালয়ের প্রেমে পড়েন ইফতেখারুল ইসলাম। এভারেস্ট বেসক্যাম্প ভ্রমণ নিয়ে ২০২১ সালে লিখেছেন বই—‘যেখানে এভারেস্ট’। হিমালয়ের ডাকে এ বছরও গিয়েছেন গোকিও। গোকিও রির শীর্ষ থেকে দেখেছেন এভারেস্টসহ বিখ্যাত সব পর্বতশিখর। সে অভিযাত্রা নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন তিনি। চতুর্থ পর্ব পড়ুন আজ।
নামচে বাজারে থামতে হবে
নামচে বাজারে থামতে হবে। এটা কেবল বিরতি নয়। এর উদ্দেশ্য উঁচু পাহাড়ি জায়গাতে ওই উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়া। নিচ থেকে এক দিনের মধ্যে অনেকটা ওপরে উঠে এলে হঠাৎ অসুস্থ লাগতে পারে। অল্টিচুড ডিজঅর্ডার এমনই এক সিরিয়াস অসুখ। উচ্চতাজনিত পীড়া। মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, বমি, ক্লান্তি ও শ্বাসকষ্ট তার লক্ষণ। পাহাড়ের উঁচুতে উঠে তেমন লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে নিচে নেমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য অনেক পানি খেতে হয়, আর স্বল্পমাত্রায় প্রতিদিন দুই বেলা খেতে হয় একটা ওষুধ। তারপরও এতটা উচ্চতায় পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়াতে হলে বাড়তি একটা দিন লাগে এক্লাইমেটাইজেশনের জন্য। ইবিসি বা গোকিওর পথে এ রকম দু–তিনটা জায়গা আছে, যেখানে থামতে হয় সবাইকে। সেদিন কিছুটা ওপরে উঠে আবার নিচে নেমে এসে রাত যাপন করতে হয়। যাঁরা আরও উঁচুতে উঠবেন বা বেশি উঁচু পর্বতশিখরে আরোহণ করবেন, তাঁদের আরও বেশি দিনের এক্লাইমেটাইজেশন লাগে।
এক্লাইমেটাইজেশনসহ আমাদের দুই দিন কাটাতে হয় নামচে বাজারে। এখানে অনেকগুলো হোটেল ও লজ আছে। নামচে হোটেলটা এই জনপদের একেবারে মাঝখানে। সেখানে পৌঁছে দেখি তাদের লাউঞ্জ বা ডাইনিং রুমে বেশ ভিড়। নানা দেশের ট্রেকার নারী ও পুরুষের হইচই আড্ডা গল্পে একেবারে জমজমাট। রাস্তায় ও হোটেলের ভেতরে ভিড় দেখে দুই বছর আগের কোভিড শুরুর অনিশ্চিত ও ত্রস্ত সময়ের কথা মনে পড়ল। হোটেলটা বেশি সুসজ্জিত। এদের ডাইনিং রুম, টেবিল, চেয়ার আর হিটিং-ব্যবস্থা সবই অত্যাধুনিক। পুরোপুরি শেরপা ঐতিহ্য অনুযায়ী সাজানো নয়।
নামচে বাজার একটা ছোটখাটো থামেল (পর্যটকবান্ধব এলাকা)। হোটেল থেকে বের হলেই সংকীর্ণ পথের দুই পাশে ছোট ছোট অনেক দোকান। পাহাড়ের গায়ে, নিচ থেকে কিছুটা উঁচু পর্যন্ত কয়েক স্তরে সাজানো। কাঠমান্ডুর থামেলের মতোই জামাকাপড়, ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম ও কারুপণ্যের পসরা সাজিয়ে রাখা। আছে ছোট ছোট ক্যাফে ও বার, এমনকি একটা বড়সড় আইরিশ পাব। অল্প একটু জায়গার মধ্যে বিভিন্ন মানের অনেকগুলো লজ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা দেশ থেকে আসা ট্রেকারদের নানা রঙের পোশাকে বর্ণময়, তাঁদের পদচারণে ও নানা ভাষার কথাবার্তায় মুখর এই জনপদ।
৮ মে নামচের হোটেল থেকে বের হয়ে কিছু চড়াই ও কিছু অসমতল পথে দুই ঘণ্টা হেঁটে এভারেস্ট ভিউ হোটেলে পৌঁছাই আমরা। আগেরবার দেখে যাওয়া মার্চ মাসের তুষারঢাকা পথ এবার একদমই অন্য রকম। যে পথে তুষার মাড়িয়ে হেঁটেছি, যেখানে শুভ্র তুষারের শয্যায় শুয়েছি, সেসব জায়গাতে এবার সবুজের চিহ্ন। দিনটা মেঘলা ছিল বলে এখান থেকে এবার এভারেস্ট দেখা গেল না। মনটাও মেঘে ঢাকা রইল। কোথায় বসে আমরা এভারেস্ট দেখেছিলাম, কফির কাপ হাতে ছবি তুলেছিলাম, সেসব কথা মনে পড়ল। তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগল অনিন্দ্যসুন্দর অমা ধবলাম দেখা গেল না বলে।
এখানেই দেখা হলো ব্রাজিল থেকে আসা সাতজনের দলটির সঙ্গে। আমি তাঁদের দেশে কখনো যাইনি শুনে তাঁরা সবাই মিলে আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন অবিলম্বে কেন আমার ব্রাজিল বেড়াতে যাওয়া উচিত। বললেন, সেই দেশটা কত সুন্দর ও আকর্ষণীয়। এই দলের সবাই হিমালয় নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত, অমা ধবলাম দেখতে আগ্রহী। অথচ অত দূর থেকে এঁরা এসেছেন মাত্র কয়েক দিনের জন্য। এখান থেকে তাঁরা অমা ধবলাম বেজ ক্যাম্প পর্যন্ত যাবেন, তারপর ফিরে যাবেন ব্রাজিলে। মাত্র চার-পাঁচ দিনের জন্য এত দূর থেকে আসা? অমা ধবলামের সৌন্দর্যের খ্যাতি কত দূর পর্যন্ত পৌঁছেছে জেনে একটু অবাক হই।
হিমালয়ের আশ্চর্য বাঁশি
দুপুরে নামচে বাজারে ফিরে যাওয়ার জন্য নিচের দিকে নামছি। আন্দ্রিয়ার সঙ্গে দেখা। এই জার্মান নারী হাঁটতে হাঁটতে অন্য কাউকে গর্ব করে বলছেন, ইউ নো, আইয়াম সিক্সটি ফাইভ! এই পুরো ট্রেকে যত সহযাত্রী পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে এ রকম মাত্র দু–তিনজন আমার সমবয়সী। যাহোক, একটু পরে তাঁর কাছাকাছি পৌঁছে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি গোকিও থেকে ফিরে এসেছেন। আন্দ্রিয়াকে বললাম, ম্যাম, আপনি তো অসাধ্য সাধন করেছেন। কিন্তু এখানে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, আমার পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে বেশ আগেই। তিনি হাসেন। বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না।’ আমি গোকিওতে যাচ্ছি শুনে তিনি বলেন, গোকিও থেকে আর একটু হেঁটে ফিফথ লেক পর্যন্ত গেলে আশপাশের সব পাহাড় ও পর্বতশিখর আরও ভালো করে দেখা যায়। আমি যেন সেখানে অবশ্যই যাই।
নিশ্চয়ই যাব, আন্দ্রিয়া। তেজ বললেন, ‘আমরা তো যেতেই পারি, কিন্তু যেতে–আসতে প্রায় একটা পুরো দিন লেগে যাবে। সময় তো লাগবেই, আন্দ্রিয়া যেতে পারলে আমি পারব না কেন? প্রয়োজনে ওখানে আরও এক দিন বেশি থাকব।’ তেজের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমি ঠিক করে নিই, গোকিও পৌঁছানোর পর কোন দিন কী কী করব। প্রথম দিন গোকিওর তিনটি লেক দেখা, পরদিন গোকিও রির শীর্ষে আরোহণ, আর তার পরদিন হিমবাহ ধরে হেঁটে পর্বতশিখরগুলো আরও কাছ থেকে দেখার জন্য ফিফথ লেক পর্যন্ত ট্রেক। তাহলে তিন দিন থাকব ওখানে।
একা একা হেঁটে নামচেতে ফেরার সময় ব্রাজিলের সেই দলটির অমা ধবলাম প্রেমের কথা ভাবছিলাম। আন্দ্রিয়ার কথা শুনে ভাবি, কী এক আশ্চর্য বাঁশি বাজাতে জানে হিমালয়। কত মানুষকে কতভাবে কত পথ দিয়ে সে তার কাছে টেনে আনে। কত দূর নিয়ে যায়।
বিকেলে নামচে বাজারের কয়েকটা দোকানে ঘুরে বেড়াই। তিব্বতি কারুশিল্পের বেশ কিছু জিনিস দেখি। জামাকাপড়, মেয়েদের সাজের জিনিস সবই আছে। সেসব দোকানের দু–একজনের সঙ্গে গল্প করে গত দুটি বছর তাদের কেমন কেটেছে, বুঝতে চেষ্টা করি। এক তরুণী মায়ের দুরন্ত ছোট্ট ছেলেটি দোকানের ভেতরে ছোটাছুটি করে, সাজানো জিনিস এলোমেলো করে দেয়। সেই তরুণীর কাছে শুনলাম কত কষ্ট করে করোনাকাল পার করেছেন তাঁরা। তাঁর সব সঞ্চয় ব্যয় করে ফেলেছেন গত দুই বছরে। তখন এই নামচে বাজার ছিল জনশূন্য। দোকানপাট বন্ধ। এখানে কারোর কোনো উপার্জন ছিল না। একটাই সান্ত্বনা—পুরো সময়টা তিনি ব্যয় করেছেন নবজাত শিশুর যত্নে। কপালে টিপ পরা ছোট্ট ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। দুটি বছর সে তার মাকে কাছে পেয়েছিল সর্বক্ষণ। এখন পুরো এলাকায় বিদেশি ট্রেকারদের ভিড়, মা দোকানের জিনিসপত্র বিক্রির জন্য ব্যস্ত—এটা সে এত সহজে মেনে নেবে কেন? তবু সে অন্য শিশুদের মতো দুই হাত জড়ো করে অতিথিদের বলে, নমস্তে।