অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম সন্তান প্রসব করেছিলেন যে নারী
সব মিলিয়ে ১২ দিনের অভিযাত্রা। এর মধ্যে যেতে-আসতেই ছয় দিন শেষ। অ্যান্টার্কটিকার সাগর-উপসাগরে ঘুরে ঘুরে কেটেছে বাকি ছয় দিন। কখনো কখনো জাহাজ থেকে নেমে ছোট নৌকায় ভেসে ভেসে দেখেছেন পেঙ্গুইনের কীর্তিকলাপ, কখনো বরফঢাকা অ্যান্টার্কটিকার ওপর করেছেন হাইকিং। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রার সেই গল্প শোনাচ্ছেন মহুয়া রউফ। আজ পড়ুন ষষ্ঠ পর্ব
রাত ১০টার মতো বাজে। জাহাজের চারতলার লাউঞ্জে উপচে পড়া ভিড়। রাতের খাবার শেষ করে আমরা চারজন ভাবলাম আড্ডা দিই খানিকক্ষণ। লাউঞ্জে আমাদের দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল অভিযানের সহদলনেতা মারিয়াম। প্রিন্সেস ডায়ানার মতো তার চুল, দৈহিক গড়ন আর হাসিতেও বেশ মিল পাওয়া যায়। অভিযাত্রীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই নারী বলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো, তোমাদের চার নারীকে নাকি কোনোভাবেই আলাদা করা যাচ্ছে না, রহস্যটা কী?’ উত্তর দেওয়ার আগেই আবার বলতে থাকল, ‘তোমরা নাকি তিন বেলা একসঙ্গে খাও, রেস্টুরেন্টে একটা টেবিলও স্থায়ীভাবে দখলে নিয়েছ শুনেছি। ঘটনা সত্যি?’
আমরা কোরাসে বলে উঠলাম, ‘ঘটনা সত্যি।’
‘তোমরা সত্যি সাহসী, ফোর ব্রেভ উইমেন,’ মারিয়াম বলল। যার নাম দিয়েছি হিটলার, সেই জার্মান সহযাত্রী বলে উঠল, ‘তবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাটাখাটনি করেছে মহুয়া। ওর দেশে তো আর্জেন্টিনার দূতাবাসই নেই। আর আমাদের তিনজনের তো ভিসাই লাগেনি।’
এই সূত্রে ইতিহাসে ডুব দিল মারিয়াম। নারীরা কতটা ঝড়ঝঞ্ঝা পার করে তবেই অ্যান্টার্কটিকায় আসতে পেরেছে, তারই ফিরিস্তি শোনাতে বসল, ‘তোমরা জানো কি না জানি না, অ্যান্টার্কটিকার সঙ্গে নারীদের ইতিহাস বহু সংগ্রামের ইতিহাস। পুরুষতন্ত্রের থাবা এখানেও পড়েছে। জাহাজে চাকরি করতে এসে সেসব বিষয় আমাকে জানতে হয়েছে।’ মারিয়াম আরও যুক্ত করল, ‘অ্যান্টার্কটিকা–সম্পর্কিত নিয়মনীতিগুলো যেহেতু পুরুষের তৈরি, স্বভাবতই সেখানে পুরুষের আধিপত্য। নারীদের অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রা নিষেধ ছিল। ধরেই নেওয়া হয়েছিল, নারীরা তাপমাত্রা বা অন্যান্য চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলাতে পারবে না।’
ষাটের দশকে অ্যান্টার্কটিকা জরিপের দায়িত্ব পান ইংরেজ বিজ্ঞানী ভিভিয়ান ফুচ। বিজ্ঞানী সাহেব তো বলেই বসলেন, নারীরা অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের ভারী সরঞ্জাম বহন করতে পারবে না। অ্যান্টার্কটিকা অভিযাত্রায় নারী অনুপযুক্ত।
পুরুষ অভিযাত্রীরা অ্যান্টার্কটিকাকে নারীর সঙ্গে তুলনা করেছে। একে ভেবেছে কুমারী। এরই মধ্যে কোনো কোনো দেশ অ্যান্টার্কটিকায় নারীকে ভিন্ন স্বার্থে ব্যবহার করেছে। অভিযাত্রী হিসেবে গমনে নিষেধাজ্ঞা থাকলে কী হবে, রাজনৈতিক দখলদারির প্রয়োজনে কিন্তু নারীকে ঠিকই ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যান্টার্কটিকায় প্রসূতি পাঠানো হয়েছে। নারী সেখানে সন্তান প্রসব করবেন আর ভৌগোলিক অংশের দাবিদার হবেন। এ ঘটনা ঘটিয়েছে আর্জেন্টিনা। সিলভিয়া মোরেলা দে পালমা ছিলেন প্রথম নারী, যিনি ১৯৭৭ সালে অ্যান্টার্কটিকার আর্জেন্টাইন ঘাঁটিতে সন্তান প্রসব করেন।
অ্যান্টার্কটিকায় অভিযান ও গবেষণাকাজে নৌবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছে বারবার। নৌবাহিনীও কখনো তাদের জাহাজে নারীর উপস্থিতিকে উৎসাহিত করেনি। বলা যেতে পারে, এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী একটা হাস্যকর অজুহাত দাঁড় করিয়েছিল। নারীদের বাধা দেওয়ার অজুহাত হিসেবে তারা বলে, অ্যান্টার্কটিকায় স্যানিটেশন–সুবিধা খুব সেকেলে। মার্কিন নৌবাহিনী অ্যান্টার্কটিকাকে ‘শুধু পুরুষের ঘাঁটি’ বলেছে।
মার্কিন নৌ কর্মকর্তা এবং মেরুবিশেষজ্ঞ অ্যাডমিরাল জর্জ ডুফেক নারীর অ্যান্টার্কটিকাযাত্রার বিষয়ে এতটাই বিমুখ ছিলেন যে ১৯৫৬ সালে বলে বসেন, নারীরা অ্যান্টার্কটিকা যেতে চাইলে তার মৃতদেহ পার হয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ এতে তাঁর এতটাই আপত্তি যে প্রয়োজনে তিনি জান দিয়ে দেবেন, তবু নারীর অ্যান্টার্কটিকাযাত্রায় সমর্থন দেবেন না। সামরিক গোষ্ঠীগুলোর শঙ্কা ছিল, নারীর উপস্থিতি যৌন অসদাচরণ বা ব্যভিচারের জন্ম দেবে।
নারীদের বিষয়ে পুরুষ অভিযাত্রীদের মনোভাব বোঝার জন্য একটা ভালো উদাহরণ হতে পারেন স্যার আর্নেস্ট হেনরি শ্যাকলটন (১৮৭৪-১৯২২)। অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে ১৯১৪ সালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন এই অ্যাংলো-আইরিশ অভিযাত্রী। অভিযানে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে তিন নারী তাঁকে চিঠি লেখে। কিন্তু তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ঘটনাটি আমাদের বলছিল হিটলার। তার কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সাসকিয়া বলল, ‘আমি তবে তোমাদের ঠিক পরের একটি ঘটনা বলি। সেটি আরও অবাক করা। ১৯৩৭ সালে অ্যান্টার্কটিকা অভিযানের আয়োজন করে একটি ব্রিটিশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। যোগদানের জন্য কত নারী আবেদন করেছিল জানো? ১ হাজার ৩০০। ভাবা যায়? ১ হাজার ৩০০ নারী। এই ১ হাজার ৩০০ আবেদনের একটিও গৃহীত হয়নি!’
রাত গভীর হচ্ছে। সমুদ্রের নাচের শব্দ আমাদের লাউঞ্জ অবধি আসে না। তবে তার দেহ সঞ্চালন আমরা টের পাই। মারিয়াম আমাদের ছেড়ে উঠে যায়। আমাদের জন্য পরের দিনের একটি প্রেজেন্টেশন তার তৈরি করতে হবে। সাইদা হাঁসফাঁস করতে থাকে। তার হাঁসফাঁসের অর্থ আমরা বুঝি। তাকে এখন জাহাজের ডেকে যেতে হবে, ‘মুখাগ্নি’র সময় হয়েছে।
সে-ও উঠে চলে যায়। লাউঞ্জে প্রায় ফাঁকা। আমি জাহাজের একেবারে নিচতলায় থাকি। সেদিকেই যাচ্ছি। জাহাজ দুলছে। এক হাতে জাহাজের দেয়াল ধরে থাকি। এতে শরীরের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় জুলিয়া উবেরুয়াগার কথা মনে পড়ে। তিনি ছিলেন জাহাজের অপারেটর। অভিযাত্রায় নয়, অ্যান্টার্কটিকার মার্কিন ঘাঁটিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই সবে ফিরেছেন। চারদিকে উৎসুক গণমাধ্যম। অ্যান্টার্কটিকায় শত শত পুরুষের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন নারীর একজন ছিলেন তিনি। নিজের অবস্থাটা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পুরুষেরা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন আমি কোনো অপ্রীতিকর-অসম্মানজনক চাকরি করে এসেছি।’
জুলিয়ার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা কৃতজ্ঞ সেই ১ হাজার ৩০০ নারীর কাছে, যারা অ্যান্টার্কটিকায় পুরুষতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চেয়েছিল। ওরা আলোর যাত্রী। এই নারীরা দুঃসাহস না দেখলে আমাদের আজ অ্যান্টার্কটিকা দেখাই হতো না।