আমার যুদ্ধ ভালো আর তোমার যুদ্ধকে খারাপ কীভাবে বলি

শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। দুই সঙ্গীসহ এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন ‘প্রথম আলো’য়। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

কিলোনিচ্ছি ওয়ার মেমোরিয়াল এর সামনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

দ্বিতীয় দিন: কোকোনাট কাল্টিভেশন বোর্ড থেকে ইরানামাডু। দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার।

বাংলোর কেয়ারটেকার সুধেনকে সকালে পাওয়া গেল না। ওকে তামিল ভাষায় ধন্যবাদসূচক ‘নানরি’ বলতে পারলে চিত্তসুখ হতো। হাঁটা শুরু করতেই পুথুকাডু। আজকের পথের বেশির ভাগ এ-৯ মহাসড়ক ধরে। রাস্তার ধারে বটের তলে যথারীতি মন্দির। গাছপালা সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও এসব মন্দিরের একটা ইতিবাচক দিক আছে। মন্দির থাকলে কেউ গাছের গোড়ায় কুঠারের ফলা বসানোর আগে দশবার ভাববে।
নারকেলবাগান শেষ হতে না হতে তালের সারি শুরু। পথে বিশাল স্তম্ভমূল নামানো বট পেলাম। একেকটা বট যেন একেকটা ছোটখাটো বাস্তুতন্ত্র। বাস্তুচ্যুত প্রাণী আর পাখিদেরও ভরসা। সাইফুল ভাই আজ বেশ ফুরফুরে আছেন। কাল শেষ বিকেলে হাঁটতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল। আজ সকাল থেকে দারুণ হাঁটছেন। শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর বিশুদ্ধ খাবার পানির কল আছে রাস্তার পাশে। লোকে নিঃসংকোচে পানি নিচ্ছে। ইয়াকাচ্চি নামক জায়গায় এসে দোসাসহকারে নাশতা সারলাম। এর পর থেকে রাস্তা ছায়াঘেরা। মূলত ইপিল ইপিল গাছের রাজত্ব।

একটু বিশ্রাম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কিছু দূর এগিয়ে রাস্তা একেবারে সরল। পথের দুই পাশ বিরানভূমি। কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সম্ভাব্য একটা কারণ হতে পারে, এগুলো মাইনফিল্ড। কিছুটা এগিয়ে মাইনফিল্ডে ডি-মাইনিং দেখার সুযোগ হলো। নানা প্রটেকটিভ গিয়ার পরে নিড়ানির মতো হাতলওয়ালা একটা যন্ত্র ধরে দূর থেকে কাজ চালাচ্ছেন কর্মীরা। জুমন ভাই বললেন, ছোট একটা পাথর ফেলে দেখব নাকি আসলেই মাইন আছে কি না! মাইনফিল্ডে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ডারউইন অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পাওয়ার দিকে আর গেলাম না! ডারউইন অ্যাওয়ার্ড সম্পর্কে এ যাত্রা একটু বলে রাখি। নিজের বুদ্ধিভ্রষ্টতা কিংবা স্থূলবুদ্ধির স্বাক্ষর রেখে মরে যাওয়া কিংবা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে দুনিয়াজুড়ে এই পুরস্কার দেওয়া হয়!

এলিফ্যান্ট পাসের কাছেই ওয়ার মনুমেন্ট। চারটা অতিকায় হাত শ্রীলঙ্কার মানচিত্র তুলে ধরে আছে। মূলত তামিল টাইগারদের পতনের পর উত্তর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার অবাধ যোগাযোগ স্থাপন উপলক্ষে বানানো হয় এই স্মৃতিস্তম্ভ। এ ছাড়া মতাদর্শ–নির্বিশেষে শ্রীলঙ্কার মানুষের একাত্মতা তুলে ধরাও এই শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য। সবার ওপর পতপত করে উড়ছে দ্বীপরাষ্ট্রটির পতাকা। আর ভাস্কর্যের চারপাশে প্রহরায় আছে চারটা সিংহ। এখান থেকে এগোলেই এলিফ্যান্ট পাস। এই পাসই জাফনা উপদ্বীপের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বাকি ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করেছে। গৃহযুদ্ধের সময় বিবদমান দুই পক্ষের কাছেই এর দখল নেওয়াটা কৌশলগত কারণে খুব জরুরি ছিল। এই দ্বীপের দখল নিয়ে পানিপথের তিন যুদ্ধের মতো এলিফ্যান্ট পাসের তিন যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম যুদ্ধে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী জিতলেও ২০০০ সালের পরের যুদ্ধে এলিফ্যান্ট পাসের দখল নেয় তামিল টাইগাররা। ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল অবধি তামিল টাইগারদের হাতেই ছিল এর নিয়ন্ত্রণ। ২০০৯ সালে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের পতনের পর আবার শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর আধিপত্য কায়েম হয় এই অঞ্চলে। আমার যুদ্ধ ভালো আর তোমার যুদ্ধকে খারাপ বলি কীভাবে? নিজ দেশের জনগণের অন্য পক্ষের প্রতি এ কেমন অন্ধ আক্রোশ!
এলিফ্যান্ট পাসের বাঁ পাশে তিস্তার বালুচরের মতো ধু ধু মরুভূমি। একসময় শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় এই লবণের মাঠ মাইনে ছেয়ে গিয়েছিল। এন্তার চেষ্টার কারণে ধাপে ধাপে মাইনমুক্ত হয়েছে এ অঞ্চল। সম্মুখসমরের এই ক্ষেত্র এখন শ্রীলঙ্কার লবণের রাজধানী। দেশের লবণের চাহিদার বেশির ভাগ মেটায় এই অঞ্চল। গৃহযুদ্ধের আগেও তা–ই ছিল। একসময় হাতি পারাপারের এই রাস্তা পেরিয়ে কারাচ্চি নামের জনপদ। এখানেও নটরাজের মূর্তি। অতিপরিচিত তাণ্ডব নৃত্যের ভঙ্গিমায় শিব। একটু এগিয়েই কেশাভার সঙ্গে পরিচয় হলো। গায়ে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের জার্সি আর ব্যাকপ্যাকের পেছনে শ্রীলঙ্কার পতাকা। কলম্বো থেকে স-ব্যাগ হেঁটে যাবে জাফনা অবধি। পথে পড়ল এলিফ্যান্ট পাসের ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন। পাশেই করপোরাল গামিনি কুলারত্না মেমোরিয়াল। পরশপিপুলগাছে ঘেরা গোছানো কম্পাউন্ড। এখানের মূল দ্রষ্টব্য দুটি। গামিনি কুলারত্নার মূর্তি আর তামিল টাইগারদের ব্যবহৃত ইম্প্রোভাইজড আর্মার্ড বুলডোজার। এই বুলডোজারের রং অবশ্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এর গতরে এখন শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর ক্যামোফ্লাজ রং। ১৯৯১ সালে এলিফ্যান্ট পাসের প্রথম যুদ্ধে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এই আর্মার্ড বুলডোজার দিয়েই শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর এলিফ্যান্ট পাস গ্যারিসনে ঢোকা ঠেকিয়েছিলেন গামিনি। অবশ্য নিজের জীবন দিয়েই তাঁকে সেটি করতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী ১৯৮১ সালে ‘পরম বীরা বিভূষণা’ উপাধির প্রবর্তন করে।

গামিনির ভাস্কর্য
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

যুদ্ধে অসমসাহসিক বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য প্রবর্তনের ১০ বছর পর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই উপাধিতে ভূষিত হন গামিনি। কম্পাউন্ডের একপাশে টিভিতে গামিনি এবং আর্মার্ড বুলডোজার নিয়ে তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছিল। লোকে খুব আগ্রহ নিয়ে তথ্যচিত্রটি দেখছে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি দেখে দায়িত্বরত সৈন্য জানতে চাইলেন, আমরা তথ্যচিত্র দেখছি না কেন? সিংহলা ভাষায় আমরা ভিখারি জানানোর পরে ভদ্রলোক জানালেন, একটু পরে ইংরেজিতে তথ্যচিত্রটি চালানো হবে, আমরা যেন ততক্ষণ অপেক্ষা করি। যথাসময়ে ইংরেজিতে তথ্যচিত্র চালানো হলো। ধারাবিবরণী শুনে আরেকবার মনে হলো, দিন শেষে ইতিহাস লেখে বিজয়ীরাই। বিজিতের দীর্ঘশ্বাস এতে কোনোকালেই লেখা থাকেনি, থাকবেও না। পৃথিবীর ইতিহাস তো আসলে সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগুরুদের নিপীড়নেরই ইতিহাস।

আবার পথে নামতেই দূর থেকে খালি মরীচিকা নামের দৃষ্টি বিভ্রম। গামিনি ওয়ার মেমোরিয়ালে না থামায় আজ খানিকটা এগিয়েই আছেন সাইফুল ভাই। রাস্তার ওপর বোতল রেখে কী জানি বিক্রি হচ্ছে। বঙ্গদেশের হরেক রকম তেল এখানেও চলে এল কি না, সেটা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম! অবশ্য জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটা মৌমাছির নানা ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধু। অবশ্য মানুষেরা আরেক কাঠি সরেস। মৌমাছির সংগ্রহ করা ঝড়তি-পড়তি মাল আবার আমরা চুরি করছি। সাইফুল ভাইকে পাওয়া গেল একটা যাত্রী ছাউনিতে। পথে আরও ডি-মাইনিং সাইট পড়ল। রাস্তার ধারে এবার তরমুজ বিরতি। দুটি খেলাম আর তিনটি তিনজনের ব্যাগে পুরলাম।

যাত্রীছাউনিতে কিছুক্ষণের জন্য আশ্রয় মিলেছিল
ছবি: লেখকের সৌজন্যে


উমিয়াইপুরাম হয়ে পারানথন। বাসস্ট্যান্ডের প্রতীক্ষালয়টা বেশ সুন্দর। রাস্তার ধারের নানা সরকারি আর দরকারি অফিস জানান দিচ্ছে সামনে একটা বড় শহর। নগরের নাম কিলিনোচ্ছি। শুনলেই মনে হয় ইতালিয়ান ফুটবল খেলোয়াড়ের নাম শুনছি। সোজা থামলাম শহরের মাঝামাঝি কন্দস্বামী মন্দিরে। এখানে ভগবান কার্তিক তথা মুরুগান পূজিত হন। আম্মাচ্ছি নামের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার না পেলেও পেঁপের জুস খেয়ে মন ভরে গেল। কিলিনোচ্ছি ওয়ার মেমোরিয়ালের বিশাল একটা দেয়ালে ফাটল ধরানো বুলেট প্রোথিত অবস্থায় আছে। আরও খানিকটা এগিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য থামলাম। কিলিনোচ্ছি শহর হিসেবে বেশ বড়। দৈর্ঘ্যে শেষই হয় না! বেড়ে যদিও খুব বড় নয়। পরের জংশনের নাম ইরানামাডু। ৩২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আজকের পথের এখানেই সমাপ্তি। মহাসড়ক থেকে বাঁয়ে কয়েক শ মিটার এগিয়ে রাতের আশ্রয়স্থলের খোঁজ পাওয়া গেল।

আরও পড়ুন