১ হাজার ৭০০ ফুট দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু পায়ে হেঁটে পেরোনোর অভিজ্ঞতা কেমন
গ্রীষ্মের রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে, হাইওয়ের উঁচু-নিচু পথ দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। ঘড়ির কাঁটায় প্রায় দুপুর ১২টা। মিউজিক প্লেয়ারে একের পর এক বাংলা গানের সুর কখনো কখনো স্মৃতিকাতর করে দিচ্ছে। ক্যামেরা হাতে জানালার পাশে বসে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যেই আকাশের দিকে চলে যাচ্ছে চোখ। পর্তুগালের নীল মেঘ আমার কাছে সব সময়ই কৌতূহল জাগানিয়া। এত ঘন নীল, পরিষ্কার আকাশ খুব কমই দেখেছি। ইউরোপীয় দেশ হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগরে ঘেরা দেশটি পর্যটকদের আকর্ষণ করার অন্যতম কারণ এর উষ্ণ আবহাওয়া। এ কারণেই গ্রীষ্মের ছুটিতে গোটা ইউরোপসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের লাখো ভ্রমণপ্রেমী অবকাশ কাটাতে এখানে ভিড় করেন।
কিছুদিন আগেই আমরা লিসবনে বসবাসরত কয়েকটি বাঙালি পরিবার মিলে একটা ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অর্থাৎ রোববার সকালে আমরা যাত্রা শুরু করব পর্তুগালের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত আভেইরো জেলার অ্যারোকা অঞ্চলে। রাজধানী লিসবন থেকে এই জেলার দূরত্ব প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার। ১৯৯ দশমিক ৯ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে মাত্র ৮১ হাজার লোকের বসবাস এই শহরে। গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, পাহাড় আর বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের কারণে এই জেলার আলাদা জনপ্রিয়তা আছে পর্যটকদের কাছে। তবে আমদের ভ্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল ‘৫১৬ অ্যারোকা’। এটিই বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ঝুলন্ত পদচারী সেতু। স্বচক্ষে এমন এক নিদর্শন না দেখলে চলে? আশপাশের কিছু দর্শনীয় জায়গাও ঘুরে দেখার পরিকল্পনা ছিল। ইস্পাতের তার দিয়ে তৈরি এই সেতু দেখতে প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শত শত পর্যটক ভিড় করেন অ্যারোকা অঞ্চলে।
সদ্য পর্তুগিজ নাগরিকত্ব অর্জন করা রাসেল আহমেদ ভাইয়ের ব্যক্তিগত গাড়িতে করে আমরা সকাল ১০টায় লিসবনের মার্তিমনিজ এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করি। পর্তুগালে এখন পুরোপুরি গ্রীষ্মকালীন ছুটি হওয়ায় চারদিকে রীতিমতো পর্যটকের মিলনমেলা। তবু লিসবন শহরে কোনো যানজট নেই। ফাঁকা রাস্তায় অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শহরের সীমানা থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠি। গ্রীষ্মের এই সময়ে তাপমাত্রা কোথাও ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কোথাও কম বা বেশি। তবে সেদিন তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি। বাইরের কড়া রোদ সঙ্গে নিয়ে আমদের গাড়ির চাকা মাইলের পর মাইল ঘুরতে থাকল। মনে হচ্ছিল, দারুণ উপভোগ্য এই পথ যদি সত্যি শেষ না হতো, তবে কেমন হতো!
একের পর এক গ্রাম আর টিলা, সড়ক পেরিয়ে একটা সময় আমরা পৌঁছাই পাহাড়ি এলাকায়। চারদিকে শুধুই সবুজ বনাঞ্চল। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সরু রাস্তায় চলতে চলতে চোখে পড়ল বেশ কিছু পর্যটকবাহী বাস। আঁকাবাঁকা হলেও এখানকার পথ বেশ নিরাপদ।
প্রায় তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে বেলা পৌনে একটায় আমরা অ্যারোকায় পৌঁছাই। গাড়ি পার্কিং থেকে সেতুর কাছে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় আধা কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। মাঝদুপুরের উত্তপ্ত সূর্যটা তখন ঠিক মাথার ওপর। তবু আমাদের ক্লান্তি নেই। ডানে-বাঁয়ে সবুজ বনানীর ভেতর টিলামাটির রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করি। যেতে যেতে দূরের আরও কিছু উঁচু পাহাড়, বাড়ি–ঘর চোখে পড়ে। সামনে এগোতেই গাছের আড়ালে চোখে পড়তে শুরু করে ঝুলন্ত সেতুটি। কয়েক কদম পা ফেলে আমরা সরাসরি পৌঁছে যাই সেতুর মূল প্রবেশদ্বারে।
সেতুটি পারাপারের অভিজ্ঞতা নিতে হলে আপনাকে অবশ্যই আগেই অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সরাসরি টিকিট কেনার কোনো ব্যবস্থা এখানে নেই। এমনকি অনলাইনে অনেক আগে টিকিট নিশ্চিত না করলেও টিকিট পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। আমাদের টিকিট কাটাই ছিল। প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য জনপ্রতি ১২ ইউরো (১ হাজার ৪০০ টাকার বেশি) এবং ৬ থেকে ১২ বছরের শিশুদের জন্য ১০ ইউরো (প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা)। এ ছাড়া ফ্যামিলি প্যাকেজ, কাপল প্যাকেজ, পর্যটক প্যাকেজসহ নানা ধরনের প্যাকেজে টিকিট কেনা যায়।
টিকিট চেকিং শেষ করে আমরা সেতুতে পা রাখি। ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড়। এর মধ্যেই দূর থেকে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। পা ফেলে সামনে এগোতে গিয়ে হঠাৎ জালের মতো তারের ফাঁকে নিচের দিকে তাকাতেই ভয় ভয় করতে লাগল। নিচে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নেই জেনেও এই যে পড়ে যাওয়ার ভয়, একেই তো বলে অ্যাডভেঞ্চার। ভয় কাটিয়ে সেতুর মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই চোখ যায় দুদিকের পাহাড় আর প্রকৃতির খোলামেলা দৃশ্যে। ইচ্ছা করছিল চোখ বুজে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পাহাড়, নদী আর প্রকৃতির সঙ্গে নীরব কথা বলি। ভিড়ভাট্টায় তা আর হয়ে ওঠে না।
আরও কিছুটা হাঁটার পর সেতুর নিচে নদীর স্বচ্ছ জলের চলাচল দেখে মনে হচ্ছিল যেন জলের ওপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছি। সেতুটি নিয়ে আমার আগ্রহ আর কৌতূহলও যেন বাড়তে থাকে। এই সেতু কীভাবে তৈরি হলো, এখানেই বা কেন তৈরি হলো ইত্যাদি প্রশ্ন মনে নিয়ে সামনে এগোতে থাকলাম। পাইভা নদীর তীরে সংযুক্ত ঝুলন্ত এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৫১৬ মিটার এবং উচ্চতা ১৭৫ মিটার। ২০১৬ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা ২০২১ সালের মে মাসে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। একই বছর ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডস সেতুটিকে ইউরোপের সেরা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ঝুলন্ত এই সেতু পুরোটাই ধাতু আর ইস্পাতের তার দিয়ে তৈরি। যেকোনো ধরনের আবহাওয়ায় এর ওপর দিয়ে চলাচল করা যায়। সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য চারপাশে জালের বেষ্টনী আছে।
ঘুরেফিরে দেখে সম্পূর্ণ ঝুলন্ত সেতুটি পায়ে হেঁটে পার হতে আমাদের লাগে প্রায় ১৪ মিনিট। সেতুটি পার হয়ে একটু সামনে গেলেই নদীর পাশে দীর্ঘ আট কিলোমিটারের কাঠের তৈরি ওয়াকওয়ে আপনাকে হাঁটার আমন্ত্রণ জানাবে। তবে ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে এবং ভিন্ন আরেক অভিজ্ঞতা নিতে হলে তার জন্য আবার আলাদা টিকিট নিতে হয়। যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা ছিল শুধু সেতুটি উপভোগ করা, তাই আমরা আবার সেতু দিয়েই ফিরে আসি। শুরু হয় নতুন গন্তব্যে আমাদের যাত্রা।