তামিল এক নারী জানতে চাইলেন, আমরা বিবাহিত কি না
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মধ্যখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। দুই সঙ্গীসহ এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন ‘প্রথম আলো’য়। আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব
তৃতীয় দিন: ইরানামাডু থেকে কানাকারইয়ানকুলাম। দূরত্ব ৩৩ দশমিক ৩১ কিলোমিটার।
শ্রীলঙ্কা চায়ের দেশ বলে পরিচিত হলেও রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের দেখা মেলে কদাচিৎ। গত তিন দিনে হাতে গোনা কয়েক কাপ চা খেয়েছি। তা-ও বেশির ভাগ নিজেরা বানিয়ে। দলের সবাই মোটামুটি চা পছন্দ করে। আমি দুধ-চিনি বিনা কড়া চায়ের ভক্ত হলেও এখানে গ্রিন-টি খেতে হচ্ছে। বিড়ালের মাছ ছেড়ে শাকাহারী হয়ে যাওয়ার মতো দশা আমার! হোটেলে আজ পানি গরম করার সরঞ্জাম না থাকায় গ্রিন-টিও মিলল না।
আজ থেকে আমাদের দলের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে। জরুরি কাজে বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সাইফুল ভাই। আজ রাতটা আমাদের সঙ্গে থাকলেও হাঁটবেন না।
আমাদের হাঁটাপথের আশপাশে অনেক গির্জা। সেখান থেকে যিশু-বন্দনার সুর ভেসে আসছে। ইরানামাডুর পরের জনপদের নাম ইনথপুরাম। এই ‘পুরাম’ মূলত তামিল শব্দ, অর্থ গ্রাম বা এলাকা। অনেক জনপদের শেষে শব্দটা জুড়ে দেওয়া আছে।
জুমন ভাই বললেন, তিন দিন ধরে হাঁটলেও রাস্তায় একটা গর্তও দেখেননি। আমিও গত তিন দিনে কোনো গর্ত দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। সকালের ঘুমভাঙানি অ্যালার্মের শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ বেকারি। সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো বাহন টুকটুককেই মূলত বেকারির রূপ দেওয়া হয়েছে। পথে পড়ল মুরিক্যান্ডি। থিরুমুরক্যান্ডির পর থেকে রাস্তার ধারে নিমের ছড়াছড়ি। বর্শা হাতে দাঁড়ানো সোনালি রঙের বিশাল কার্তিক মূর্তির দেখা পাওয়া গেল। অনেকটাই ইন্দোনেশিয়ার বাতু গুহার কার্তিক মূর্তির মতোই দেখতে। সনাতন ধর্মের সমর-দেবতার দেখা এই অঞ্চলে হরহামেশাই মেলে।
পথে আরও একটা মাইন ফিল্ড পড়ল। এই কদিনে দেখা অন্য মাইন ফিল্ডের চেয়ে এটি খানিকটা ভিন্ন। অন্য ফিল্ডগুলোয় কাঁটাতারের বেড়ার বেষ্টনী থাকে, এই মাঠে বেড়ার বদলে আছে গরু-ছাগল বেঁধে রাখার জন্য ব্যবহৃত খুঁটি। আকারে অনেকটাই তেমন। শুধু অগ্রভাগ নানান রঙে রাঙানো। পরের জনপদ কোকাভিল। এখানেই আছে একটা সুদৃশ্য আর্মি মেমোরিয়াল। অস্ত্র হাতে একজন সৈন্যের মূর্তি আছে। নিচে কোকাভিল যুদ্ধে নিহতদের তালিকা।
দিগন্তে কোদালিয়া মেঘ আর রাস্তার দুই ধারে গুল্মজাতীয় গাছ। হাঁটতে নেমে প্রথমবারের মতো বন্য প্রাণী পারাপারের করিডর পেলাম। ছোট একটা দোকানও পাওয়া গেল। পানির বোতল পুনরায় ভরে নিয়ে ফের চলা। এবার রাস্তায় ছোট ছোট চড়াই-উতরাই। এই বিরানভূমিতেও আছে ছোট টিনে ঘেরা ডাস্টবিন। গায়ে লেখা ‘দ্য ফরেস্ট ইজ নট আ প্লেস টু ডাম্প গারবেজ’।
কিলাভানকুলাম পিল্লাইয়ার এসে একটা দোকান পাওয়া গেল। সকাল থেকে খালি পেটেই সাড়ে ১৪ কিলোমিটার হাঁটা হয়ে গেছে। বানরুটি আর মাইলো খেয়ে শরীরে পোড়ানোর মতো কিছু এনার্জি জোগাড় হলো। নিজেদের ঝুলিতে থাকা সব তামিল শব্দ দিয়ে দোকানের দুই নারীর সঙ্গে কথোপকথন চালানোর চেষ্টা চালালাম। ভানাক্কাম, নানরি, ইল্লে আর আম-কুল্লে—এ কয়টা শব্দই আমাদের তামিল শব্দভান্ডারের সম্বল। এক নারী জিজ্ঞেস করে বসলেন আমরা বিবাহিত কি না। কৃত্রিম লাজুক হাসি মুখে ঝুলিয়ে ‘না’-সূচক উত্তর দিলাম।
কিছুটা এগিয়ে একদম প্রাকৃতিক পরিবেশে ধনেশ পাখি দেখার সুযোগ হলো পথে। প্রলম্বিত ঠোঁটের এসব বিহঙ্গের দেখা আমাদের আলীকদমের বনে-জঙ্গলে একসময় সহজেই পাওয়া যেত। সংরক্ষণের পরিবর্তে আমরা সংহারে মজে থাকায় আজকাল এদের দেখা মেলাই ভার। শিকার করা ধনেশের ইস্পাতদৃঢ় হলদে ঠোঁটের দেখা অবশ্য আলীকদমের পাড়াগুলোয় মেলে। শিকারের স্মারক হিসেবে পাড়ার শিকারিরা এসব সংগ্রহে রাখে। ফের ধনেশ দেখার লোভে রাস্তার চেয়ে পথের ধারেই চোখ রাখছি বেশি। পরের জনপদ পান্নিকানকুলাম। গুল্মজাতীয় গাছ ছাড়া পথের ধারে আর কিচ্ছু নেই। যুদ্ধে অঙ্গ হারানোদের জন্য একটা ওয়েলনেস সেন্টার পড়ল পথে। যাক, কেউ অন্তত তাঁদের কথা ভেবেছে। তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে অঙ্গচ্ছেদ নিয়ে বেঁচে থাকা রীতিমতো অভিশাপ। মূল সড়ক থেকে অনেক লাল মাটির রাস্তা ঢুকেছে ভেতরের ছোট ছোট গ্রামে। সবুজের পরিমাণও বেড়েছে কিছুটা। রাস্তার চড়াই-উতরাই অবশ্য আগের মতোই। খুব বেশি উচ্চতার কোনো চড়াই নেই পুরো পথে। এক জায়গায় একসঙ্গে তিনটা ধনেশ দেখলাম। এখানে কত সুন্দর নির্ভয়ে চলাফেরা করছে। আমাদের দেশে অবশ্য কদিন বাদে ধনেশ দেখতে হলে ইন্টারনেট খুলে ছবি দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না। আরও আরও ধনেশ। উড়ন্ত ধনেশ, বিশ্রামরত ধনেশ। এ যেন ধনেশের অভয়ারণ্য।
দিনের প্রথম খাবার দোকান পেয়ে সোজা গাছতলার বেঞ্চিতে। বিটরুটের তরকারি দিয়ে পরোটা। ফেরার সময় দোকানি ভদ্রলোক দুজনকে দুই বোতল পানি উপহার দিলেন। পাশেই স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি অ্যাসোসিয়েশনের সুন্দর ভবন। যুদ্ধাহত সৈনিকদের সব ধরনের আঘাতের জন্যই নানা চিকিৎসা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। পরের বাজারের নাম মুল্লাইতিভু। আজ রোববার বলে বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। আমরা এগোচ্ছি মানকুলামের দিকে। রাস্তার ধারে বিশাল শিবমূর্তি। একেবারে ছোট্ট শহর মানকুলাম। একরের পর একর এলাকাজুড়ে নিষ্প্রাণ ভূমি। মাইনের ভয়ে কেউ এখানে চাষবাস করে না। দিনের পর দিন নিষ্ফলা পড়ে আছে জমি।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, আমি কেন হাঁটি? কী লাভ হয় হেঁটে? মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। একটা কারণ হলো, জন্মের পর মোটামুটি এক বছরের মধ্যেই হাঁটা শিখে ফেলা যায়। আলাদা করে কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা সরঞ্জামের দরকার পড়ে না। পর্বতারোহণ, সাইকেল চালানো কিংবা সাঁতার কাটা যেমন আলাদা করে শিখতে হয়, এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যাপারই নেই। সামনের পা পেছনে আনতে পারলেই হাঁটা হয়ে যায়। নিজের এক জোড়া পা আর জুতার ওপর ভরসা করে নেমে পড়া চলে। অবশ্য লম্বা হাঁটতে গেলে ‘আউট অব কমফোর্ট জোনে’ দীর্ঘদিন টিকে থাকার বিদ্যাটুকু পেটে কিংবা পায়ে থাকা চাই। আর শারীরিক কিংবা মানসিক পরিশ্রম করার সক্ষমতাটুকুও দরকার।
কুনজুক্কুলামে এসে চা-বিরতি। ভাঙা ইংরেজিতে আমাদের চাহিদা বোঝানোর চেষ্টা করতেই বুঝলাম, দোকানি নারী খুব ভালো ইংরেজি বলেন। পথে একটা দেয়ালে লাল ক্যাপ পরা চে গুয়েভারার দেখা পাওয়া গেল। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুঁজিবাদীদের হারিয়ে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মার্ক্সবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক পরপর এই দেশে এলেও কোথাও ব্যানার-লিফলেট-ফেস্টুন চোখে পড়েনি। পুটুকুলাম জংশন থেকে পথের ধারের গাছপালা আবার পাতলা হয়ে গেল। পথে পেলাম দাউদ হোটেল। গত তিন দিনে এই প্রথম হাইওয়ে হোটেলের দেখা পেলাম। হাইওয়ে হোটেলের প্রথা মেনে এর সামনের পার্কিংয়ের স্থানে বিশাল বিশাল গর্ত। বাস-লরির চাকা উদ্ভূত গর্ত নিশ্চয়ই। কানাকারইয়ানকুলাম থেকে কিছুটা এগিয়ে আনা গেস্টহাউস। এখানেই সকালে বাসে করে এসে আবাস গেড়েছে সাইফুল ভাই। ব্যাকপ্যাক কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখলাম এখানেই। গেস্টহাউসের সবই সুন্দর। সামনে চিলতে বারান্দা, পেছনে বেশ চওড়া বৈঠকখানা। গেস্টহাউসটির সবই ঠিক আছে, শুধু চিন্তার বিষয়, এখানে মাতালদের বেশ দৌরাত্ম্য!