তীব্র শীতের মধ্যেও বুখারার যেসব জায়গা ঘুরে দেখেছি, তার মধ্যে অন্যতম পো-ই-কালান মসজিদ, মিরি-আরব মাদ্রাসা, আর্ক দুর্গ, সামানি মসোলিয়াম, চার মিনার মাদ্রাসা, বোলো হাউস মসজিদ, সিতোরাই মহি হোসা প্রাসাদ। নামগুলো একটু খটমট, মনে রাখাও কঠিন, কিন্তু মনে রাখা সহজ এদের সৌন্দর্য।
সামানি মসোলিয়াম কমপ্লেক্সে আমাদের গাইড বখতিয়ার নবজাতকদের দোলনার আদলে তৈরি একধরনের ছোট বিছানা দেখালেন। এটাকে তারা বলে বেশিক। ফলের গাছ দিয়ে তৈরি। প্রস্রাব করার জন্য এগুলোয় আলাদা কাঠের তৈরি একধরনের অক্ষ থাকে। ২ কি ৩ বছর বয়স পর্যন্ত দোলনা বিছানা ব্যবহার করা হয়, যদিও আধুনিক মায়েরা নাকি ডায়াপারই ব্যবহার করেন। কত যে আছে জানার, ভ্রমণ আসলেই বিস্ময়কর।
কমপ্লেক্সের কাছাকাছি একটা বাজারে গেলাম এরপর। কোনোভাবেই নামটা মনে করতে পারছি না। আগেও বলছি, ভিনদেশের পাইকারি বা খোলাবাজারে যাওয়া আমার খুব পছন্দ। উজবেকিস্তানের মতো নতুন দেশের বাজার তো আমার জন্য আরও আকর্ষণীয়। বাজারের বেশির ভাগ বিক্রেতাই বয়স্ক নারী। কটন অয়েল দেখলাম, বিভিন্ন রকমের চাল, মসলা, বাদাম, খোলা বিস্কুট, হালুয়া—কত শত জানা-অজানা জিনিসের পসরা। প্রায় প্রতিটি দোকানেই কিছু না কিছু খেতে দিচ্ছিল, কেউ বাদাম, কেউ হালুয়া, কেউ চা, কেউ বিস্কুট। তাদের শারীরিক ভাষাতেই এত আন্তরিকতা। মুখের ভাষা মিললে কথা হয়তো শেষই হতো না। গাইডকে অনুরোধ করে আমাদের সঙ্গে ছবি তুলল।
বুখারায় এরপর যে স্থাপনা নিয়ে লিখতে চাই, সেটি একটি প্রাসাদ। সিতোরাই মহিহোস্সা প্রাসাদ। বুখারার শেষ আমির সায়িদ মির মুহাম্মদ আলিম খানের (১৮৮০-১৯৪৪) প্রাসাদ। উনিশ শতকের শেষের দিকে তৈরি এই জায়গাটা আমার মনে দাগ কেটেছে গভীরভাবে। না, প্রাসাদের বিশালতা দেখে নয়, একসঙ্গে অনেক ময়ূর দেখে। প্রাসাদে ঢুকতেই ওদের চোখে পড়ল। তাদের গলার নীল-সবুজ পেখমের সজ্জা আমি কোনো দিনই ভুলব না। অনেকক্ষণ ধরে ময়ূরের রং দেখলাম। জীবনের খুবই কম সময় আমার মন খুশিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়েছে, ওই দিন এ রকমই একটি। প্রাসাদের দেয়ালের কারুকাজ ছিল দেখার মতো—নিখুঁত, সূক্ষ্ম আর জটিল কিন্তু দেখতে মনে হবে একদম সহজ সুন্দর।
ওই দিনই আমরা বুখারা থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে সুলতান নামে পরিচিত স্থান ‘চর বকর’ সমাধিক্ষেত্রে গিয়েছিলাম। উজবেক ভাষায় ‘চার’কে বলে ‘চর’। চর বকরকে বলা হয় ‘মৃতদের শহর’। চারজন বকর হলেন আবু বকর সাদ, আবু বকর ফজল, আবু বকর হোমিদ আর আবু বকর তরখান। এখানে তাঁরা বংশধরসহ সমাধিস্থ। সোভিয়েত আমলে অনেক কিছু নষ্ট হলেও স্বাধীনতার পর উজবেকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভের (১৯৩৮-২০১৬) উদ্যোগে এই স্থান পুনরায় উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি গাইড এই প্রেসিডেন্টের কথা বলেছেন। স্বাধীনতার পর নব্বইয়ের দশক বা তারপরে উজবেকিস্তানের অনেক স্থাপনা তাঁর তত্ত্বাবধানে পুনরুদ্ধার হয়, ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত স্থাপনাসহ সব ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকেই তিনি সংরক্ষণ করেন, যার প্রতিফলন আধুনিক উজবেকিস্তানে স্পষ্ট। এখানকার বেশ কয়েকটি স্থাপনা পরবর্তী সময়ে ‘ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। যাহোক, বুখারার সফর শেষ হলো সন্ধ্যার দিকে চার বকরের প্রাঙ্গণে একঝাঁক কবুতরের সঙ্গে—হাতে, মাথায় কবুতর আর কবুতর।
পরদিন ট্রেনে সমরখন্দ যাব। তার আগপর্যন্ত আমাদের নিজেদের মতো করে ঘোরাঘুরির ইচ্ছা। দু–তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হলাম, লাবি খউজ কমপ্লেক্স আমাদের হোটেল থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। রাতের খাবার খেতে দুজন হাঁটতে হাঁটতে ওদিকেই গেলাম। রাত সাড়ে আটটার মতো বাজে তখন—অথচ চারপাশ কী ঠান্ডা আর সুনসান। একটু ভয় ভয় লাগছিল, ভয় ভাঙল শিশুদের দেখে। শিশুরা দিব্যি একা একা হেঁটে এদিক-সেদিক যাচ্ছে। দেখলাম সব বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করা, রাতভর এভাবেই নাকি থাকে। আঁচ করলাম দেশটা ভালোই নিরাপদ। রাতের খাবার খেয়ে ফেরার পথে দেখি এক মা (আমার বয়সীই হবে) তার ৪ কি ৫ বছরের ছেলে আর মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। হাঁটতে হাঁটতে কথা হলো। নাম তার জারিন। ছোট দুজনের নাম ইয়াসমিনা আর আজিজ বেগ। মহি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল, মেসি না রোনালদো, কাকে বেশি পছন্দ?
আজিজ বলল, রোনালদো।
এটা-ওটা কথার পর জানলাম জারিন নিজেও গেস্টহাউসের মালিক। সেলুনও আছে। গেস্টহাউসে দেখে যেতে অনুরোধ করল। আমরাও রাজি হলাম, তার আন্তরিকতা উপেক্ষা করার ইচ্ছা আমার বা মহির কারোরই নেই। গেস্টহাউস সুন্দর, সাজানো–গোছানো, পরিপাটি। নিচতলায় তারা সপরিবার থাকে, ওপরের তলায় গেস্টহাউস। রুমের ভেতর আধুনিক হিটার–ব্যবস্থা, খোলা ব্যালকনি। আমরা যদি আরেকবার যাই, ওখানে থাকার চিন্তা অবশ্যই করব। তারকা হোটেলে সব ব্যবস্থা থাকলেও জারিনের আন্তরিকতা মুদ্রায় কেনা যাবে না। শেষের দিকে তার স্বামীও যোগ দিল আমাদের গল্পে।
‘সেন্ট্রাল এশিয়া’ নামে এই গেস্টহাউসে যদি কেউ যান, ইয়াসমিনা আর আজিজকে আমাদের সালাম আর আদর দিয়ে আসবেন।
(চলবে)