জাহাজে ভাসতে ভাসতে দেখেছি মায়াবী মেরুজ্যোতির ঝলকানি
নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিসকেই কেতাবি বাংলায় বলে মেরুজ্যোতি। মায়াবী রহস্যময় এই আলোর ঝলকানি বিশ্বের যেসব দেশ থেকে দেখা যায়, নরওয়ে তার মধ্যে অন্যতম। গত মাসে এই আশ্চর্য নিসর্গদৃশ্যের সাক্ষী হলেন সৌরভ মাহমুদ
‘আকাশে নর্দার্ন লাইটস দেখা যাচ্ছে।’
রাত সাড়ে ১০টায় জাহাজের সেন্ট্রাল স্পিকারে ঘোষণা এল। আগেই জেনেছিলাম, আজ রাতে অরোরা বা মেরুজ্যোতি দেখা যাবে। কিন্তু কখন, তা নির্দিষ্ট করে জানতাম না। এখন ঘোষণা শুনে উত্তেজনা চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। কেবিন থেকে বের হয়ে রীতিমতো দৌড়ে ছাদে চলে গেলাম। আহা, উত্তরের আলো! জীবনে প্রথম দেখলাম এই অদ্ভুত আলো।
রাতের অন্ধকারে সবুজ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, মাঝেমধ্যে নীল ও সাদা এই আলো। আলোর আভা একটি কেন্দ্র থেকে এসে চারদিকে ঝলক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির মতো। নানা গতিতে আলোরা নাচছে আকাশের গায়ে। এ গতি কখনো দ্রুত আবার কখনো কিছুটা মন্থর। আলোর ঝলকের নাচ কয়েক মিনিট পর্যন্ত চলতে দেখলাম। কখনো এমনও মনে হচ্ছিল, হাতে টর্চ জ্বালিয়ে আকাশের চারদিকে কেউ ঘোরাচ্ছে। নানা আকারের মায়াবী আলোর ঝলক। গোলাকার, পর্দার মতো, সর্পিল, কখনোবা বাঁকানোও। আলোর জ্যোতিগুলো কখনো খুব গাঢ় আবার কখনো খুব হালকা। আকাশের বুকে এ আলো নানা ধরনের চিত্র এঁকে কিছুক্ষণ পরই হারিয়ে যাচ্ছিল। তখন মনে হচ্ছিল, এ তো আলো নয়, যেন আলোর মায়া।
নরওয়ের বার্গেন শহর থেকে এই জাহাজে যাত্রা করেছিলাম। ১২ দিনের অভিযানে আমরা ঘুরে আসব দেশটির উত্তর-পূর্ব উপকূলের রাশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন শহর কিরকেনেস পর্যন্ত। আজ ১ এপ্রিল। কিছুক্ষণ আগে লোফোটেন দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর সোলভেয়ার ছেড়ে এসেছে জাহাজ। রাতের নিস্তব্ধতায় শহরের বাতির আলোয় লোফোটেনের বরফের পর্বতগুলোকে অপরূপ লাগছে। রাতের প্রকৃতি দেখতে দেখতেই শুনতে পাই সেই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা।
আমাদের জাহাজে যাত্রী আছে প্রায় ২০০। প্রায় সবাই ছাদে চলে এসেছে। এখানে বাতাসের গতি বেশ। হিমাঙ্কের নিচে ৭ তাপমাত্রায় এমন বাতাসে ঠান্ডা ধরিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু অরোরা দেখার উত্তেজনায় সবারই বুঝি ‘শীতবোধ’ চলে গেছে! সবাই আনন্দ করছে, ছবি তুলছে, অরোরাকে সাক্ষী রেখে আলিঙ্গন করছে।
অরোরার ছবি তোলা খুব কঠিন কাজ। ছবি তোলার চেয়ে খালি চোখে দেখাটাকেই আমার কাছে উপভোগ্য মনে হলো বেশি। অরোরার প্রতি আমার এই গভীর নিমগ্নতা বুঝি একজন টের পেয়েছিলেন। তিনি নিজে থেকে এগিয়ে এসে অরোরার আলোর সঙ্গে আমার একটি ছবি তুলে দিলেন। সেই সূত্রে ইতালীয় এই নারী ভ্রমণসঙ্গীর সঙ্গে পরিচিত হলাম।
তারপর ক্যামেরা হাতে আমিও অপার্থিব আলোর কিছু ছবি তুলে রাখলাম। ছবি তোলার সময় জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী মার্টিন ব্রেন্ডেল (১৮৬২-১৯৩৯) আর ভূগোলবিদ ওটো বাশিনের (১৮৬৫-১৯৩৩) কথা মনে পড়ল। ১৮৯২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা দুজনই উত্তরের আলোর প্রথম ছবি তুলেছিলেন।
জাহাজ এগিয়ে চলছে। ঠিকরে পড়া আলোয় পর্বতের চূড়া দেখে মনে হলো স্বপ্নীল কোনো জায়গায় আছি। এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে আরোরার আলোয় ডুবে থাকলাম আমরা। ধীরে ধীরে অরোরার আলো নিভে গেছে। রাতের আকাশ এখন নিকষ কালো। খেয়াল করে দেখলাম ছাদে আমি ছাড়া আর একজন আছেন। তিনিও কি আমার মতো স্বপ্নে বিভোর!