প্লাস্টিক বোতলের কায়াকে সাঙ্গু নদে ১১১ কিলোমিটার পাড়ি দিলেন তিন তরুণ
ছোট–বড় ১৩৪টি প্লাস্টিক বোতল দিয়ে একটা কায়াক বানিয়েছেন প্রদীপ যোবায়ার, চো সিং মারমা ও সামিরা আফরোজ। তারপর সেটা নিয়ে নেমে পড়েছেন খরস্রোতা সাঙ্গু নদে। রেমাক্রি থেকে ১১১ কিলোমিটার পাহাড়ি নৌপথে বইঠা বেয়ে বান্দরবান শহরে গিয়ে উঠেছেন। কাজটা করতে তাঁদের সময় লেগেছে তিন দিন। প্রদীপ যোবায়ারের কাছে সেই রোমাঞ্চকর অভিযানের গল্প শুনেছেন সজীব মিয়া
পাহাড়ের টানে আগেও বহুবার এসেছি, পেশাগত কারণে বান্দরবান এসেছি দেড় বছর। বেসরকারি একটা সংস্থার হয়ে প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করি। আমার বাসাটা বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি যাওয়ার পথে, সাঙ্গু নদের পাশে। বাসাটা একেবারে নদীর পাড়ে হওয়ায় সব সময় দেখি, অনেক প্লাস্টিক বোতল নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। বান্দরবানে প্রচুর পর্যটক আসেন। তাঁরা বান্দরবান শহর থেকে বোতল নিয়ে যান। ফেরার সময় সেগুলো আর সঙ্গে নিয়ে আসেন না, কাজ শেষে পথেই ফেলে আসেন। পরিবেশ-প্রকৃতির খুব বাজে অবস্থা।
ভাবতাম কীভাবে বোতলের ব্যবহার কমানো যায়, পুনর্ব্যবহার করা যায়। ভাবতে ভাবতে গত বছর নৌকার আইডিয়া মাথায় আসে। নৌকা বানাতে পারলে অন্তত সেটা দেখে মানুষ সচেতন হবে। এ ছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে ‘ওয়াটার স্পোর্টস’কে উৎসাহিত করা যাবে। আইডিয়া মাথায় আসার পরই জিনিসটা কীভাবে বানাব, জানতে ইন্টারনেট ঘাঁটি। দেখি ২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডে একটা অভিযাত্রী দল প্লাস্টিক বোতল দিয়ে কায়াক বানিয়ে অভিযান করেছে। সেখান থেকেই নৌকার আইডিয়াটা কায়াকে বদলে যায়।
দু-একবার কায়াক চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু কায়াক বানানোর কাজ, তা–ও আবার বোতল দিয়ে, নিজের কাছেই অবাস্তব মনে হলো। পরামর্শ নিতে নিউজিল্যান্ডের দলটার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু স্পনসর নিয়ে কাজটা করায় তারাও খুব বেশি সহযোগিতা করতে পারল না।
এরপর বন্ধু সামিরা আফরোজ আর চো সিং মারমার সঙ্গে আইডিয়া শেয়ার করলাম। সামিরা আমার ঢাকার বন্ধু। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ। এভারেস্ট বেজক্যাম্পসহ পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়ায়। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজের সূত্রে বান্দরবান থাকে। সামিরা শুনে উৎসাহ জোগাল। চো সিং স্থানীয় মানুষ। তারও আগ্রহের কমতি নেই। তিনজনে মিলে দুই-তিন মাস সময় নিয়ে নকশা করলাম। স্থানীয় নৌকার কথা মাথায় রেখে সেটা তৈরি করা হলো। তারপর প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে পাটাতন বানালাম। পানিতে নামিয়ে দেখি খুব একটা ভাসে না। তারপর সংশোধন করলাম। এভাবে দুইটা কায়াক বানিয়েছি আমরা। দ্বিতীয় কায়াক নিয়ে নদীতে বান্দরবান শহরের পুরোনো ব্রিজ থেকে নতুন ব্রিজ পর্যন্ত ঘুরেছি।
তারপর বড় যাত্রার প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২ লিটারের ৮২টি আর ৫ লিটারের ৫২টি ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল দিয়ে বানাই আমাদের তৃতীয়তম কায়াক। ৬ অক্টোবর সকালে রেমাক্রি বাজার ঘাট থেকে শুরু হয় আমাদের অভিযান।
নোঙর তোলো তোলো
ঘাট ছাড়ার সময় স্রোতের তীব্রতা অতটা বুঝিনি। খানিকটা যাওয়ার পর প্রথম বাঁক। বাঁয়ে গিয়ে তারপর আবার ডানে। খরস্রোতা সাঙ্গুর যৌবনের সাক্ষাৎ মিলল তখন। তীব্র স্রোতে বইঠা বাওয়ার চেষ্টা বৃথা। হিতে বিপরীত হতে পারে ভেবে কোনোভাবে হাল ধরে থাকি। রাফটিংয়ের অনুভূতি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
আজ আমার কায়াকসঙ্গী সামিরা আফরোজ। আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলছে উদ্ধারকারী কায়াকসহ সহযোগী দলের ট্রলার। আমাদের চ্যালেঞ্জ এখন দুটি—স্রোত আর পাথর। এ পথে নিয়মিত যেসব নৌযান চলে, সেগুলোও অনেক সময় পাথরে বাড়ি খেয়ে দুমড়েমুচড়ে যায়। আমাদেরটা তো প্লাস্টিক বোতল, কাঠ আর বাঁশে বানানো মামুলি কায়াক, কী হয় কে জানে!
কিছুটা ভয় নিয়েই এগোচ্ছিলাম। এরই মধ্যে পাথরের গায়ে বাড়ি খেল আমাদের কায়াক। প্লাস্টিকের বোতল বলেই হয়তো পাথরে লেগে সরে এল। তারপর স্রোত সামলে ভেসে গেল সামনের দিকে। আমরা হাল ধরার চেষ্টা করতে করতেই ঢুকে পড়ল জলা ঝোপে। একদম আটকা পড়ে গেলাম। বড় একটা পাথর। তার গায়ে জন্মানো লতাগুল্মের ঝোপ। এমনভাবে আটকে গেল, একচুলও নাড়াতে পারলাম না।
সহযোগী দলের সদস্যরা সামনে এগিয়ে গেছে। ভাবছি এখন কী করব? কায়াকে বসে নাড়াচাড়া করলেও উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা। পাথরের ওপর নেমে যে কায়াকটা বের করে আনব, স্রোতের মধ্যে সেটাও সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত সহায়তাকারীরাই এগিয়ে আসেন। কিন্তু এত স্রোত যে সেখানে থামার উপায় নেই। আমাদের উদ্দেশে দড়ি ছুড়ে মারেন তাঁরা। দড়ি ধরে টানাটানি করেও কোনো লাভ হলো না। শুধু শুধু হাত ব্যথা হলো। এরই মধ্যে উদ্ধারকারী দল থেকে একজন পানিতে নেমে পড়লেন। ঝুঁকি নিয়ে সাঁতরে এগিয়ে এলেন। আমাদের ঝোপ থেকে বের করলেন।
ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে পথটা আমাদের জন্য সহজ হয়ে গেল। সাহসীও করে তুলল। সেই সাহসের জোরেই বড় পাথর হয়ে তিন্দু পৌঁছালাম।
তিন্দুতে বিরতি
আমাদের অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য কায়াকের সক্ষমতা বোঝা। সাঙ্গুর প্রবল স্রোতে টিকে গেলে দেশের যেকোনো নদীতেই কায়াকটা স্বাচ্ছন্দ্যে চলবে। পর্যটকসহ স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্লাস্টিক–দূষণ, প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের বার্তা পৌঁছানোসহ অ্যাডভেঞ্চার কর্মকাণ্ডে আগ্রহী করা আরেকটি লক্ষ্য।
তিন্দুতে ঘণ্টা দুয়েকের বিরতিতে আমরা সেই কাজটিই করি। যাঁরা রেমাক্রি ঘুরতে যান, তাঁরা তিন্দু হয়েই যান। দুদিনের ছুটিতে অনেক পর্যটক এসেছেন। ঘাটে পৌঁছালে প্লাস্টিকের কায়াকটার বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তাঁরা। কীভাবে বানালাম, কীভাবে চলে, ঝুঁকি কতটুকু, কত কিছুই না জানতে চান তাঁরা। আমরা তাঁদের কৌতূহল নিবারণের চেষ্টা করি।
অগ্রবর্তী দল আগেই তিন্দু পৌঁছেছিল। তারাই দুপুরের খাবার তৈরি করেছে। খেয়ে থানচির উদ্দেশে রওনা করি।
আগেই ধারণা করছিলাম, রেমাক্রি থেকে তিন্দু পর্যন্ত যাত্রাপথটাই হবে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। এরপর স্রোত থাকলেও পাথরে আঘাত লেগে দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম। তা-ই হলো। তিন্দু থেকে থানচি পর্যন্ত পথটুকু আর কঠিন মনে হলো না। ততক্ষণে কায়াক নিয়ন্ত্রণে আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ২৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে থানচিতে শেষ হলো প্রথম দিনের অভিযান।
প্রবারণার প্রণামি
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা। তাঁদের মধ্যে এ সময় প্রণামি দেওয়ার চল আছে। রুমা বাজার এসে আমরাও প্রণামি পেলাম। পাশ দিয়ে দুটি ট্রলার যাচ্ছিল। প্লাস্টিকের কায়াক দেখে কাছে এসে থামালেন। তাঁদের চোখেমুখে কৌতূহল। রেমাক্রি থেকে নিরাপদে এত দূর পর্যন্ত এসেছি শুনে তাঁদের বিস্ময়ের শেষ নেই। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলেন। তারপর হাসিমুখে আমার হাতে ২০০ টাকা তুলে দিলেন। টাকা হাতে নিয়ে আমি হতবাক। তখন ভদ্রলোক বললেন, এটা প্রবারণার প্রণামি!
থানচি থেকে ৭ অক্টোবর রুমার রিজুক ঝরনায় পৌঁছে সেদিনের মতো যাত্রাবিরতি করেছিলাম। তৃতীয় দিনের অভিযানে আমরা যাচ্ছি বান্দরবান। গত দুদিন আমার সঙ্গী ছিল সামিরা আফরোজ, আজ চো সিং মারমা। কায়াকে শুকনা খাবার আর পানি রেখেছি। মাঝেমধ্যে খাই। গত দুদিন টানা কায়াক চালিয়ে ব্যথায় টনটন করছে শরীর। তারপরও অভিযান সমাপ্ত হচ্ছে ভেবে আনন্দ লাগছে।
রুমা বাজার থেকে বান্দরবান ৪৫ কিলোমিটার। পুরো পথটাই লোকালয়ঘেঁষা। যেতে যেতে দেখছি পাড়ার লোকজন আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসছেন। পাশ দিয়ে ট্রলার যাওয়ার সময় থেমে আলাপ জুড়ে দিচ্ছে। যাত্রার শেষের দিকে এমন হলো, সহযোগী দলের চেয়ে স্থানীয় মানুষের সহায়তা পাচ্ছিলাম বেশি।
রোয়াংছড়ির বেতছড়ায় বিরতি নিয়েছিলাম। স্থানীয় সেনাবাহিনী ক্যাম্পে হাজিরা দিয়ে যখন কায়াকে উঠব, দেখি স্থানীয় কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছেন। তাঁদের চোখেমুখে আমাদের চেনা কৌতূহল। মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই বিস্তারিত বললাম। খুশি হয়ে একজন হাতে ১০০ টাকা ধরিয়ে দিলেন! মানুষের অকৃত্রিম এই ভালোবাসা নিয়ে সন্ধ্যার পর বান্দরবান বাজার ঘাটে এসে পৌঁছালাম।