নাইরোবিতে ফ্লাইট মিস

মাদাগাস্কারে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি চার সাইক্লিস্ট। আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্রটিতে সাইকেলে ঘুরে দারুণ দারুণ সব অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন মুনতাসির মামুন। আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব

কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দর
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে মাদাগাস্কারের যাত্রাপথটা বেশ লম্বা। শুরুতে ঢাকা থেকে যেতে হবে কলকাতায়। সেখানে কয়েক ঘণ্টার বিরতি। তারপর মুম্বাই। মুম্বাইয়ে আবার ফ্লাইটবদল। তার মানে আবার প্রথম থেকে শুরু; ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা তল্লাশি, বাক্স খুলে দেখানো, সাইকেলের চাকায় হাওয়া কমিয়ে রাখা হয়েছে কি না দেখা ইত্যাদি।

সন্ধ্যার পরপরই কলকাতায় পৌঁছে গেলাম। মুম্বাইয়ের ফ্লাইট রাত ৯টা ২০ মিনিটে। ট্রানজিটে আমরা। তাই এয়ারপোর্টের বাইরে যাওয়া হলো না। অবশ্য চার ঘণ্টার জন্য বের হয়ে আবার ঢুকতে যে পরিমাণ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে, তার চেয়ে বসে থাকা ঢের আরামের। চারজন বসে বসে তাই মাদাগাস্কার নিয়ে আরও কিছুটা জানার চেষ্টায় মন দিলাম।

আরও পড়ুন
মুম্বাই বিমানবন্দর
ছবি: সংগৃহীত

অনেককাল আগে মাদাগাস্কারে উপনিবেশ গেড়েছিল ফরাসিরা। তা অবশ্য ভারতের চন্দননগরেও গেড়েছিল। আদতে দুনিয়ার কোন মুলুক তাদের দৃষ্টির অগোচর ছিল! ‘সভ্য করা’র গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে ইউরোপীয়রা উপনিবেশ বিস্তার করেছিল সারা দুনিয়ায়। নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতিও চাপিয়ে দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ব্রাজিলে পর্তুগিজ জায়গা করে নিয়েছে, আর্জেন্টিনায় স্প্যানিশ, যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজি। স্থানীয় লোকেদের যখন নিজের ভাষা ছেড়ে অন্যের বর্ণমালা লিখতে-পড়তে শিখতে হয়েছিল, কী ভীষণ বিভীষিকাময়ই না ছিল সময়টা! ফরাসিরা আফ্রিকা দাপিয়েছে। মাদাগাস্কারও বাদ পড়েনি। সারা দেশে ফরাসি ভাষা আর খাবারের আধিপত্য।

এসব ভাবতে ভাবতেই মুম্বাই ফ্লাইটের ঘোষণা এল। আমাদের সাইকেল দুটো পাওয়া গেল ওভারসাইজ কাউন্টার থেকে, আর বাকি দুটো ব্যাগ লাগেজ বেল্ট থেকে। নিরাপত্তাচৌকি সাইকেলগুলো আটকে দিল। খুলতে না হলেও ভেতরে কী আছে, তার বৃত্তান্ত বলতে হলো। সাইকেলের বাক্সগুলো দূর থেকে দেখতে টিভির বাক্স বলে ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই প্রথম দেখায় কেউ বিশ্বাস করতে পারে না যে এর মধ্যে সাইকেল থাকবে। তবে এটাও ঠিক, আমাদের মতো কেউ সাইকেল নিয়ে ভ্রমণ করবে, এটা এখনো বেশির ভাগ এয়ারপোর্ট বা এয়ারলাইনস সহজে মেনে নিতে পারে না। তবে এবার এয়ারলাইনসের কাউন্টারে সাইকেল নিয়ে কোনো বিবাদ করল না। অনায়াস কাজ হয়ে যাওয়ায় বেশ ফুরফুরে আমেজ আমাদের। ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে ফ্লাইট। মানে সারা রাত অপেক্ষা।

সাইকেলের বাক্সগুলো দূর থেকে দেখতে টিভির বাক্স বলে ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে
ছবি: লেখক

বসে বসে ঝিমানো ছাড়া করার কিছু নেই। মাদাগাস্কারের ইতিহাস পড়তেও মন চাইছে না। ওয়াইফাই আছে কতগুলো জায়গায়, তবে আমরা যেখানে বসা, সেখানে পাওয়া গেল না। ভারতের সিম থাকলে ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যেত, সিম নেই। কিঞ্চিৎ ঝিমুনি থেকে হালকা ঘুমিয়ে পড়তেই ঘোষণা। আমাদের ফ্লাইটের কথাই তো বলছে। ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হবে।

মুশকিল! ফ্লাইট দেরিতে ছাড়লে ঝামেলা হয়ে যাবে। কেনিয়ার নাইরোবি থেকে মাদাগাস্কারের আন্তানানারিভোর ফ্লাইটের মধ্যে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের বিরতি। মুম্বাই থেকে নাইরোবির ফ্লাইট যদি দেরিতে ছাড়ে, তবে আমরা নির্ঘাত পরের ফ্লাইটটা মিস করব। হোটেলের আগাম বুকিং দেওয়া আছে, খরচটা জলে যাবে।

ভোঁ-দৌড়ে আবার কেনিয়া এয়ারওয়েজের বুথে গেলাম। আমাদের দুটি বোর্ডিং পাস দেওয়া হয়েছিল। শেষ গন্তব্যে লাগেজ পাওয়া যাবে, সে হিসেবে লাগেজ ট্যাগ। এয়ারলাইনস থেকে আশ্বাস দেওয়া হলো, পরের ফ্লাইট যেহেতু এই এয়ারলাইনসের, তাই এখনকার বিলম্বের জন্য আমাদের পরের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবে। প্রয়োজন হলে তাদের খরচে নাইরোবিতে থাকতে হতে পারে এক দিন। তার মানে হলো, ২৯ জুন দুপুরে পৌঁছানোর পরিবর্তে ৩০ জুন পৌঁছাতে হবে, যদি না আর কোনো অঘটন ঘটে।

এবার আর অন্য কোথাও না বসে ডিপারচার গেটের পাশে বসলাম। সময়মতো যেহেতু ছাড়ছে না, বলতেও পারছে না কখন ছাড়বে, গাট্টা মেরে পড়ে থাকা আর অপেক্ষা করা। নাইরোবি যেতে ছয় ঘণ্টা লাগবে। সে হিসেবে একেবারে ছোট ফ্লাইটও নয়।

ফ্লাইটের নতুন সময় ১১টা। তার মানে, সেদিন নিশ্চিতভাবেই আন্তানানারিভো যেতে পারছি না। গেট থেকেই বলা হলো, যাঁদের কানেকটিং ফ্লাইট আছে, তাঁদের আজ নাইরোবিতে থাকতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে এয়ারলাইনস সব ব্যবস্থা করে দেবে। এখন হোটেলের রিজার্ভেশনটা যে করেই হোক পরিবর্তন করতে হবে। অন্তত একটা মেইলও যদি করে দেওয়া যায়, তো নাইরোবিতে গিয়ে ফোনে কথা বলা যাবে। ওয়াইফাইয়ের জায়গা খুঁজে আমাদের বিশদ পরিস্থিতি জানিয়ে হোটেলে মেইল করা হলো। নাইরোবিতে গিয়ে দেখা যাবে কী উত্তর এল!

বেলা ১১টায় আমাদের ফ্লাইট ছেড়ে গেল মুম্বাইয়ের মাটি। এবার আর ঘুম ঠেকাল গেল না। তবে খুব যে ঘুম হলো, তা-ও নয়। বিমানকর্মীরা খাবারের ট্রলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তার মানে, বড়জোর ঘণ্টাখানেক হলো উড়াল দিয়েছে। ভালোই হলো একদিক দিয়ে, কেনিয়ায় আবার কবে আসা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, অল্প সময়ে একটু ঘুরে দেখা যাবে।

নাইরোবির বিমানবন্দরটি ছিমছাম, ঝকঝকে
ছবি: সংগৃহীত

চারটা বাজার খানিক আগে বিমানের চাকা নাইরোবির মাটি ছুঁল। জানালা দিয়ে ভালো করে এয়ারপোর্টটা দেখা যাচ্ছে। আরেব্বাবা! অনায়াসেই একে উন্নত যেকোনো দেশের এয়ারপোর্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে। বিমানের জানালা থেকে সবকিছু ছিমছাম, ঝকঝকে লাগছে। দেখা যাক ভেতরে কী অপেক্ষা করছে।

মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। এয়ারলাইনস থেকে আমাদের জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোর্ডিং ব্রিজ থেকে নামতেই ট্রানজিটের প্ল্যাকার্ড নিয়ে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন। বিমানের জানালা দিয়ে যেমন দেখা গিয়েছিল, ভেতরটাও তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঝকমকে বা ফ্লাসি না হলেও যত্ন নেওয়া হয় বোঝা গেল। এখন পর্যন্ত দারুণ। আতিথেয়তা বলুন আর সিস্টেম বলুন, যেখানে যতটুকু সময় দরকার তার বাড়তি একটুও নয়। আমাদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কয়েকজন নাগরিক ছিলেন। তাঁরাও মাদাগাস্কারের ফ্লাইট মিস করেছেন। পরদিন ফ্লাইট একসঙ্গেই।

(চলবে)