কুকুরগুলোর প্রভুভক্তির পাশাপাশি দেশভক্তিও প্রবল
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী। তাঁর সঙ্গে হণ্টনযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন জুমন নিয়াজ। বাবর আলী সেই অভিযানের রোজনামচা লিখছেন প্রথম আলোয়। আজ পড়ুন দশম পর্ব।
দশম দিন: ডাম্বুলা-গুরুওয়েলা। দূরত্ব: ৪০.৭০ কিলোমিটার
শ্রীলঙ্কায় আসার পর এই প্রথম সকালটা শুরু হলো কফি দিয়ে। হোটেল রুমেই রোস্টেড কফির দুটো স্যাশে দিয়ে গিয়েছিল। এতে দুজন কফিপ্রেমীর বড়ই উপকার হয়েছে। একটু ক্যাফেইন যে শরীরকে কী পরিমাণ চনমনে করতে পারে!
পথে নামতেই হোটেল ‘সন্ন্যাসা’র সাইনবোর্ড। দুই গৃহত্যাগীর তো এখানেই রাতের তাঁবু গাড়া উচিত ছিল! আজকের পথচলা বি-৬১৫ নামক সড়ক ধরে। এটা অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তা। শ্রীলঙ্কায় মহাসড়কগুলো ‘এ’ আদ্যক্ষর দিয়ে শুরু হয়। আর ‘বি’ আদ্যক্ষর বরাদ্দ অপেক্ষাকৃত ছোট সড়কগুলোর জন্য। এই রাস্তার অবশ্য পোশাকি নাম ‘বাকামুনা-কালুগাহাওয়েলা’ সড়ক।
সকাল থেকেই পথের ধারে অনেক লটারির দোকান দেখলাম। শ্রীলঙ্কার অন্যতম সাধারণ দৃশ্য। পথের ধারে টিনের খোপের মতো স্টলে বিক্রি হয় এই লটারির টিকিট। নারীরাই মূলত বিক্রেতা। ক্রেতার ক্ষেত্রে অবশ্য লিঙ্গভেদ নেই। লোকে কেনেও দেদার। মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সের অধীনে পরিচালিত হয় এই লটারি। চালায় ডিএলবি বা ডেভেলপমেন্ট লটারি বোর্ড। ভাগ্যপরীক্ষার খেলায় শ্রীলঙ্কার জনগণ বেশ আগ্রহী। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পুরস্কারস্বরূপ এক অনুষ্ঠানে ৫০টি ১০০ টাকা মূল্যের প্রাইজবন্ড পেয়েছিলাম। তিন মাস অন্তর অন্তর সেই প্রাইজবন্ডের ড্র হতো। মায়ের নির্দেশে দৈনিক পত্রিকায় ৫০ খানা প্রাইজবন্ডের নম্বর মিলিয়ে দেখার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকেই লটারি নিয়ে আমার যাবতীয় আগ্রহ উবে গেছে।
আজ সকাল থেকেই রাস্তার কুকুরের হ্যাপায় আমাদের জেরবার অবস্থা। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই ঘেউ ঘেউ করে আত্মারাম খাঁচাছাড়া করে ফেলছে। অথচ প্রভুভক্ত এই প্রাণী আমার অসম্ভব প্রিয়। দারুণ সব স্মৃতি আছে কুকুর নিয়ে। টানা ছয় দিন এক পাহাড়ি কুকুর আমাদের সঙ্গে ট্রেক করেছিল, সে স্মৃতি মহার্ঘ। অন্য দিকে শ্রীলঙ্কান সারমেয়রা ‘বিনা ঘেউ ঘেউয়ে নাহি দিব যেতে’ পন্থা অবলম্বন করছে! জুমন ভাইয়ের ধারণা, এরা প্রভুভক্ত হওয়ার পাশাপাশি দেশভক্তও। দেশি পরিচিত কেউ গেলে এরা টুঁ শব্দটি করে না। এদের দমনের টোটকা হিসেবে আশপাশে কোরিয়ান বসতি গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখলেন তিনি। জুমন ভাইয়ের ছোটবেলায় যমুনা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করতে প্রচুর কোরিয়ান এসেছিলেন টাঙ্গাইল শহরে। তাঁরা আসার তিন মাসের মধ্যে টাঙ্গাইল শহর নাকি কুকুরশূন্য হয়ে পড়েছিল! জীবের প্রতি প্রেম ওরা নিজেদের মাংসল জিভ দিয়েই সেরেছিল!
আজকের রাস্তায় প্রচুর ছায়াবৃক্ষের ছড়াছড়ি। হাঁটতে বেশ আরামই লাগছে। নারকেলগাছের ডালে অতিকায় এক ইগল নজর কাড়ল। পাহাড়গুলো আজ আরও কাছে। রাস্তা আর পাহাড়ের মধ্যে দূরত্ব মাত্রই কয়েকটা কৃষিজমির। বাড়িঘর একদমই নেই পথে। এই রাস্তা রাঙ্গুনিয়ার চন্দ্রঘোনা থেকে বাঙালহালিয়া হয়ে বান্দরবানে যাওয়ার পথটুকু মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার কালো পিচের ধার ঘেঁষে অনেক ইলেকট্রিক ডেইজি বা নাকফুল ফুটে আছে। এর অল্প দূরে শনের সবুজাভ ঝোপ।
সবেধন নীলমণি একটা দোকান পেয়ে বসে পড়লাম। নারকেলের চাটনি দিয়ে রুটি খাওয়া হলো সকালের নাশতায়। পথে নামতেই রাস্তার ধার ঘেঁষে হাতির মল। অতিকায় প্রাণীর দেহনির্যাসও অতিকায়। এ ছাড়া আছে জায়গায় জায়গায় হাতি পারাপারের করিডরসংক্রান্ত সাবধানবাণী। জানা ছিল, এখানে একটা এলিফ্যান্ট করিডর আছে। এখানে হাঁটতে দেওয়ার কথাও নয়। তবে কেউ থামাল না দেখে এগোচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে সেনাবাহিনীর এক সদস্য বাইকে করে এসে থামালেন।
তিনি সিংহলা ভাষায় কথা বলা শুরু করতেই এই ভাষায় আমাদের অপারপগতার কথা জানালাম। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে উনি যা জানালেন, তার মোদ্দাকথা হলো, এটা মিন্নেরিয়া-গিরিতালে নেচার রিজার্ভ। সংরক্ষিত এলাকা বিধায় এখানে হাঁটা নিষিদ্ধ। হাতি ছাড়া চিতাবাঘেরও প্রাচুর্য এখানে। এ ছাড়া আছে শ্লথ ভালুক। তাহলে কী উপায়, জানতে চাইতেই তিনি বলেন, ‘বাকামুনায় চলে যাও। ওখান থেকে আবার হাঁটতে পারবে।’ খানিক পেছনে হেঁটে আর্মি ক্যাম্পের সামনে থেকে বাসে তুলে দিলেন। বাস প্রায় ১০ কিলোমিটার সামনে বাকামুনায় নামিয়ে দিতেই আবার হাঁটা ধরলাম।
বাকামুনা নামক জায়গাটার অবস্থান নর্থ সেন্ট্রাল প্রভিন্সে। সেন্ট্রাল প্রভিন্স থেকে আবার ঢুকলাম নর্থ সেন্ট্রাল প্রভিন্সে। স্বভাবতই জেলাও বদলে গেল। নতুন জেলার নাম পলোন্নারাওয়া। আমাদের দেশেও পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল নিয়ে বেরোলে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় গাড়িতে উঠতে হয়। পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতু পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে পেরোনো যায় না। শ্রীলঙ্কায় এসেও সেই অভিজ্ঞতা হলো। কিছু দূর এগোতেই বিপরীত দিক থেকে আসা দুজন মোটরসাইকেল আরোহী সম্ভাষণসূচক হাত তুললেন। আমরাও প্রত্যুত্তরে হাত নেড়ে জবাব দিলাম।
একটু পরই মোটরবাইক ঘুরিয়ে এপাশে চলে এলেন অনুরাধাপুরার বাসিন্দা চেতিয়া আর ওর বান্ধবী। মিনিট দুয়েক গল্প হলো। এই রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা একদমই কম। রাস্তার নানা জায়গা দখল করে লোকে ধান শুকানোর কাজে ব্যবহার করছে। রাস্তা থেকে খানিকটা সাধারণ চলতিপথ ধরে এগোলে বাকামুনা পিল্লা। একটা খাল থেকে ধাপে ধাপে পানি পড়ছে। পানির যাত্রাপথে বানানো হয়েছে গোসলের জায়গা। তরুণ-তরুণীরা এখানে আসেন মূলত স্লাইড করতে।
কুরুওয়িইয়াইয়াতে আবার চা–বিরতি। চায়ে চিনি খাব না বলায় সঙ্গে একটা গুড়ের টুকরা দিল। চা শেষ করে হাঁটা শুরু করতেই মুখের ভেতরে চালান করে দিলাম ওটা। কিছু দূর এগিয়ে কুমারেল্লা হিস্ট্রিক্যাল রুইনস। চারপাশে পোড়া ইটের বেষ্টনীর মাঝখানে বেদি। এর বাইরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এগিয়েই আম্বান গঙ্গা। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় নদী মহাবেলি গঙ্গার শাখা এটি। বিশাল সব বোল্ডারের জমিনের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে চলেছে নদীটি। নদী দেখে মনটা ভরে গেল। হাঁটতে হাঁটতে জুমন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, রাস্তায় হাতি সামনে পড়লে কী করবেন? ‘আমি ছোট প্রাণী। আমি আর কী করব, যা করার হাতিই করবে!’ জুমন ভাইয়ের উত্তর!
সামনে এগিয়ে বি-৬১৫ ছেড়ে আরেকটু ছোট বি-৩১২ রাস্তা ধরলাম। এটি আমাদের নিয়ে যাবে হেট্টিপোলার দিকে। রাস্তায় আরেকজন থামালেন আমাদের। ঠিকুজি–কোষ্ঠী জেনে শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন। পথের ধারে অনেক মাইলপোস্টের সঙ্গে কত না মানুষের শুভকামনাও পেছনে ফেলে আসছি! এই দ্বীপদেশের পথঘাট ছুঁয়ে যাওয়া এই দুজনের আজ থেকে বহু বছর বাদে ক্ষণেকের জন্যও কি মনে পড়বে ওদের? কিরিওয়া থেকে এগিয়ে ওয়াটালাপ্পান নামক একটা খাবার খেলাম। নারকেলের দুধ, ডিম আর গুড় দিয়ে বানানো খাবারটা বেশ ভিন্ন স্বাদের। খুব অসাধারণ বলব না, তবে অনন্য অবশ্যই।
পা চালিয়ে কিছুটা এগিয়েই আবার ঢুকে পড়লাম সেন্ট্রাল প্রভিন্সে। জেলার নাম মাতালে। গতকালের আবাস ডাম্বুলা শহরও অবশ্য মাতালে জেলারই অংশ। পথে পড়ল ওয়াসগামুয়া ন্যাশনাল পার্কের সাইনবোর্ড। মূল রাস্তা থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে যেতে হয়। এই জাতীয় উদ্যানও বিখ্যাত শ্রীলঙ্কান হাতির জন্য। মহাওয়েলি গাম্মানা থেকে এগিয়ে কিছু দূর পরপর রত্নালংকারের দোকান। শ্রীলঙ্কা রত্নের জন্যও বেশ বিখ্যাত। দ্বীপরাষ্ট্রটিকে এখনো অনেকেই চেনেন রত্নদ্বীপ হিসেবে। একদল শিশুর সঙ্গে দেখা হলো হাত্তোতা আমুনায়। ওরা সবাই মিলে সাইকেল চালাতে বের হয়েছে। অপরিচয়ের প্রাথমিক ধাক্কাটুকু কেটে যাওয়ার পর ওদের সঙ্গে ছবি তোলা হলো। সাইকেল নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত এল ওরা আমাদের পিছু পিছু।
আরও আরও রত্নরাজির দোকান। এখানে একই সঙ্গে রত্নগর্ভ থেকে মণিমাণিক্য উত্তোলনও করা হয়। আগে ছোটখাটো জিনিস দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হতো। এখন মাটির গর্ভে প্রবেশ করে এক্সক্যাভেটরের ধাতব দাঁত। পাহাড় আমাদের আরও কাছে চলে এসেছে। পোস্ট অফিস থেকে বাঁয়ে একটা লাল মাটির ছোট রাস্তা এগিয়েছে। সঙ্গে ক্যাসেটের ফিতার মতো সরু খাল। বিকেলে হাঁটতে দারুণ লাগল এই রাস্তায়। বান্দরবানের লাল মাটির চান্দের গাড়ির রাস্তাগুলো এমনই হয়। সেখানে রাস্তা বানান আদা আর হলুদ ব্যবসায়ীরা; কিছু ক্ষেত্রে কাঠ পাচারকারীরা। এখানে বানিয়েছে রত্ন কোম্পানিগুলো। রত্ন ব্যবসা অবৈধ কিছু নয় শ্রীলঙ্কায়। কাপিইয়াইয়ার এই রাস্তায় রত্ন কোম্পানিগুলো মাটির অভ্যন্তর থেকে বের করে আনছে মণি–মুক্তা। অবশ্য শ্রীলঙ্কার অন্য একটি শহর রত্নভান্ডারের জন্য অতীব বিখ্যাত। শহরের নামের মধ্যেই আছে রত্ন। নগরীর নাম রত্নপুরা।
টানা পা চালিয়ে সুন্দর পাহাড়ি নদী কালু গঙ্গার ওপরের সেতু পেরোলাম। একচিলতে আকাশ বুকে ধারণ করে থির হয়ে আছে। পাহাড়ি নদী বলে জোয়ার-ভাটা নেই। খালি একদিকেই অতি ধীরলয়ে বয়ে চলছে। নদীর ঠিক ওপার থেকে লাজ্ঞালা শহর শুরু। একটা রংচটা সাইনবোর্ড জানাচ্ছে যে এটি গ্রিন সিটি। নতুন শহরের শেষ মাথায় বাসস্ট্যান্ড। পাহাড়ি শহরের বাসস্ট্যান্ডগুলোর মতোই ছবির মতো সুন্দর।
বেশ কয়েকটা ছোট ছোট জলাশয় পেরিয়ে আর উঁচুনিচু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে গুরুওয়েলা। এখানকার লাকগালা গেস্টহাউসে আজকের ঠাঁই। একদম ছোট্ট জনপদ। রাতের খাবারের জন্য এই জনপদের একমাত্র দোকানে গিয়ে মালকিনকে অনেক কষ্টে খাবারের কথা বোঝানো গেল। ইংরেজিতে অক্ষরজ্ঞান নেই ভদ্রমহিলার। অবশ্য পথে নামলে মৌলিক চাহিদাগুলোর সংস্থানের ক্ষেত্রে ভাষা তেমন কোনো বাধা হয়ে ওঠে না।