ঘোরাঘুরিটা আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কীভাবে এই নেশায় পড়লাম, আমি নিজেও জানি না। শৈশব থেকেই মনে ভ্রমণবাসনা পুষে রেখেছি। কিন্তু তখন তো খুব একটা ঘুরতে যেতে পারতাম না। এখন সুযোগ হলেই তাই ব্যাগ গুছিয়ে দে ছুট।
আর যখন ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকি না, তখনো দিনের অনেকটা সময় ইউটিউবে বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাপন নিয়ে ভ্লগ দেখি। এসব ভিডিওতে অদ্ভুত সব জায়গার সন্ধান পাওয়া যায়। অদ্ভুত বলতে যেখানে যেতে গেলে একটু শঙ্কা থাকে, ঝুঁকি থাকে—সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর যাত্রা। এসব ভিডিও দেখলেই মনে হয়, তখনই সেখানে ছুটে যাই। কিন্তু ব্যস্ততা যে মোরে দেয় না ছুটি!
কাজ থেকে ছুটি না মিললে মানসভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি, ঘুরে আসি সেসব জায়গা। আর ভাবতে থাকি কখন সুযোগ হবে, কখন সশরীর যাব। এক বছর আগে তেমনই একটি জায়গায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার পরিবার। জায়গাটা থাইল্যান্ডের চেংমাইয়ের একটা পাহাড়ি রিসোর্ট। শহর থেকে গাড়িতে দুই ঘণ্টার পথ। জায়গাটা লোকালয় থেকে দূরে, নেটওয়ার্কও নেই।
চেংমাই থেকে গাড়িতে পথ ধরেছিলাম। চারপাশে পাহাড় আর পাহাড়। তার মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। পথে তেমন লোকজন চোখে পড়ল না। গাড়ির চালক থাই ছাড়া অন্য ভাষা বোঝেন না। তাই তাঁর সঙ্গেও খুব একটা আলাপ হচ্ছে না। একমনে গাড়ি চালাচ্ছেন ভদ্রলোক।
পাহাড়ের গভীরে যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম, যে গাড়িতে এসেছি, সেটা ঠিক পাহাড়ে ওঠার উপযোগী না। চড়াই-উতরাই পেরোতে গিয়ে বিষয়টা আমরা বুঝতে পারলাম। গাড়িটা ওপরে উঠতে গেলেই স্লিপ করছে, পেছনে চলে আসছে। তারপর থেকে পাহাড়ি প্রকৃতি উপভোগ করব কি, বারবার স্লিপ কাটতে দেখে মনে জেঁকে বসল ভয়। ভেতরে-ভেতরে অস্থিরতা—কখন শেষ হবে পথ। এই ভুলের জন্য চালককে কী বলব, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না।
যাহোক, আরও অনেকক্ষণ ভয়কে সঙ্গী করে একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামল। এখানে গাড়ি পার্ক করে আমাদের পাহাড় চূড়ায় নিয়ে যাবেন চালক, সেখানেই রিসোর্ট। চালককে গাইড মেনে আমরা পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। যত ওপরে উঠতে থাকি, তত বাড়তে থাকে ভয়। চারপাশে রাজ্যের নীরবতা। তারপরও বুনো পথে দু-একটা ছবি তুলি। ছবি তুলে একবার চেয়ে দেখি চালক নেই। লোকটা গেল কই। মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই যে যোগাযোগ করব। এমনিতেই অচেনা-অজানা জায়গা। পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যাওয়ার শঙ্কা। এর মধ্যে চালক উধাও। রাগ–শঙ্কা, দুই–ই হচ্ছিল।
আবার গাড়ির কাছে ফিরে যাওয়াও তখন কঠিন। আমরা পাহাড়ের অনেকটা ওপরে চলে আসছি। কী একটা রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত—ভাবতেই পারিনি চালককে এভাবে হারিয়ে ফেলব। পর্যটক খুব একটা আসে না বলে এই জায়গাটা পছন্দ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়া যাবে। আর তখন মনে হচ্ছিল এত দুর্গম জায়গায় আসার সিদ্ধান্তটাই ভুল।
অবশেষে চালককে পাওয়া গেল। তিনি বুঝতেই পারেননি আমরা হারিয়ে যাব। যে কারণে অন্য পথে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আবার পথচলা শুরু হলো। প্রকৃতি এখানে যেন নিজের মতো করে স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে অনেক আগের কোনো সিনেমার লোকেশনে চলে এসেছি। চারপাশটা দেখছি, কিন্তু মনের ভয়টা কাটছিল না। এভাবে পাহাড়ে ট্রেকিং একসময় শেষ হলো।
পাহাড়ের একদম চূড়ায় পৌঁছে গেছি আমরা। চারপাশটা দেখে এত কষ্ট, এত ভয় সব ভুলে গেলাম। চারপাশটা এত সুন্দর। চারপাশে শুধুই মেঘ। রিসোর্টের পরিবেশ দেখে মনে হলো পথের সব কষ্ট সার্থক। এটাই আমার সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারাস জার্নি।
সবকিছু থেকে দূরে থাকার মতো এমন জায়গা আমার ভীষণ পছন্দ। যেখানে সিনেমার মতো একটু সাসপেন্স থাকবে। অনেক জায়গায়ই তো যাওয়া হয়, কিন্তু এক্সপ্লোর কি সেই অর্থে করতে পারি। সবাই যাচ্ছে, দেখছে, ফিরছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের কাছে যেতে আমি পছন্দ করি। কোলাহল আর কাজের পৃথিবী থেকে কয়েকটা দিন দূরে ছিলাম। কোথায় কী ঘটছে জানতাম না। পরিবারের মানুষদের সঙ্গে গল্পগুজব করেই সময় কেটেছে। আপনজনদের সঙ্গে পাহাড়, মেঘ আর আকাশ দেখে কাটানো সময়টা আমার কাছে এখনো স্মৃতি হয়ে আছে।
অনুলিখন: মনজুরুল আলম