‘জীবনটাই বদলে গেল রে, মা’

সমুদ্রে প্রথমবার পা রেখে মা–বাবা পুলকিত হয়ে ওঠেন
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মা এগিয়ে যান ধীরে ধীরে। একটু একটু করে স্পষ্ট হয় তাঁর চোখের সামনে সেই সাদা ফেনারাশির কম্পন। সোজা সামনে দূরে চোখ রেখে মা আবিষ্কার করতে থাকেন সাগরের অস্তিত্ব। আমি পাশে থেকে তাঁর মুখের প্রতিটি অভিব্যক্তি দেখার জন্য হাঁটি । হঠাৎ মা খপ করে আমার হাত চেপে ধরেন।

বলেন, ‘আমার পায়ে কী লাগল?’ নিচে তাকিয়ে দেখেন, সমুদ্রের জল! আমার মায়ের পাতা স্পর্শ করে গেল সাগরের জলরাশি। মা আমার বিস্ময়ে আর আনন্দে হতবাক! আর আমার চোখে সেই স্বপ্নপূরণের অশ্রু।

খুব অবাক হয়েছিলাম যখন জেনেছিলাম, মা–বাবা কখনো কোথাও ঘুরতে যাননি। আর কক্সবাজারে সমুদ্র দেখা—সে তো বিস্তর কল্পনা।

কখনো যদি মাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘তুমি সমুদ্র দেখেছ?’ উত্তরে বলতেন, ‘হুমম, টিভিতে কত দেখেছি।’

বাবার বয়স ৭০ পার হয়েছে। মায়ের ৬০ ছুঁই ছুঁই। এই এত বয়সেও কোনো মানুষ নিজের চোখে সমুদ্র দেখেনি, এটা আমি কোনোভাবেই হজম করতে পারলাম না। আমরা তো শিক্ষা সফরে, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের সঙ্গে এখানে-ওখানে কত বেড়াতে যাই, ঘুরি, কত কিছু দেখি। অন্তত সমুদ্র তো মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের ভেতর দেখা হয়েই যায় আমাদের।

অথচ আমাদের মা-বাবা কিনা আজও সমুদ্র দেখেননি! তাঁদের বয়স হয়েছে, কত রকম রোগবালাই আর প্রতিবন্ধকতা তাঁদের শরীরজুড়ে। এখনো যা–ও চলাফেরা করতে পারেন, কিছুদিন পর হয়তো এটাও আর পারবেন না। তারপর? তাঁরা সমুদ্র দেখবেন না? একজীবনে আমাদের মা-বাবার সমুদ্র দেখা হবে না?

না, এটা হতে পারে না। চট করে কথা বললাম অন্য চার ভাইবোনের সঙ্গে। পূজার ছুটিতে আমরা সবাই মিলে মা-বাবাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাব।

ভাইবোনেরা প্রথমে খুব উচ্ছ্বসিত হলেও পরে একেকজনের এটা-ওটা কাজ আর সমস্যা দেখা দিতে লাগল। এ ছাড়া মা-বাবার বয়স হয়েছে। মানচিত্রের উত্তরের একটা জেলা থেকে দক্ষিণে যাওয়া। লম্বা সময়, অনেক খরচ। এতটা দূর যেতে যেতে মা-বাবা অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া বাবার ডায়াবেটিস। ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়ার সমস্যাটা মাথায় রাখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপও আছে। কাজেই সব দিক বিবেচনায় কক্সবাজারে যাওয়ার পরিকল্পনাটা প্রায় বাতিলই হয়ে যায়।

কিন্তু আমার জেদ চেপে গেল। আমার মা–বাবা সমুদ্রের জলে পা ভেজাবেন,আমি সেই দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে চাই, যখন সাগরের ঢেউ প্রথমবার আমার মায়ের পায়ের পাতা স্পর্শ করবে আর মায়ের সারা শরীর কেঁপে উঠবে আনন্দে, মুগ্ধতায় আর অপার বিস্ময়ে।

উদ্যোগটা শুরু করলাম। বাসে বা ট্রেনে নয়, মা-বাবা সমুদ্রে যাবেন বিমানে চড়ে। ভাইবোনদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ হলো। বিমানের টিকিট কাটার দায়িত্ব নিল একজন। আর বিমানের ভাড়ার টাকা দেবে আরেকজন। বাড়ি থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া ট্রেনে, সেই দায়িত্ব আরেকজনের। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে মা-বাবার পরার মতো উপযুক্ত পোশাক ও অনুষঙ্গ? সে দায়িত্বও আরেকজন নিয়ে নিল। ব্যস, সব তো হলো।

বাবা চিরকাল চাকরি করেছেন। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য নিজের জন্য কিছুই করেননি। আর মা? কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো দূরে থাক, আজীবন বাড়ি আঁকড়ে ধরে সন্তানদের লালন-পালন, সংসার করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। সমুদ্র বা পাহাড় দূরে থাক, বেড়ানো ব্যাপারটার সঙ্গেই তো তাঁদের পরিচয় নেই। কাজেই বাড়ি থেকে তাঁদের বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বের হতে রাজি করানো যেন ভীষণ কঠিন একটা কাজ। তবু সেটাও হয়ে গেল সব সন্তানের সম্মিলিত উদ্যোগে।

এবার ভ্রমণের পালা। গ্রামের বাড়ি থেকে মা-বাবাকে ঢাকার ট্রেনে তুলে দিলেন ছোট ভাই। ঢাকার স্টেশন থেকে তাঁদের নিয়ে এক রাত ঢাকায় বিশ্রাম করে পরদিন সকালে বিমানে যাত্রা। দূরপাল্লার বাসে চড়তেও যাঁদের আপত্তি, তাঁরা জীবনে প্রথম পা রাখলেন বিমানবন্দরে। সেখানে বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করা, লাগেজ চেক, আলোঝলমলে অপেক্ষা কক্ষ ইত্যাদি দেখে দুজনই যেন মন্ত্রমুগ্ধ।

বিমানে প্রবেশ করে মা-বাবার বিস্ময় কাটে না। সিটবেল্ট বাঁধা থেকে শুরু করে এটা-ওটা—সবকিছুতেই অবাক হচ্ছেন। রানওয়ে থেকে প্লেনের চাকা যখন ওপরে উঠতে শুরু করল, তখন হালকা ঝাঁকুনিতে খানিক ভয়, খানিক শিহরণে দুজন মানুষের চোখের ভাষা, মুখের ভাষা আমি হাভাতের মতো গিলতে থাকলাম। মেঘের ভেতর দিয়ে বিমানের দুটো ডানা দেখিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগছে?’ ‘এ তো স্বপ্ন!’ বলে নিজের গায়ে চিমটি কাটলেন। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি প্রাণভরে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। বললেন, ‘এই জীবনে আমার জন্য এটাও লেখা ছিল নাকি রে মা?’

বিমানের ভেতর যখন কক্সবাজারে অবতরণের কথা ঘোষণা হলো, তখন মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘টেলিভিশনে কতবার দেখেছি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। এটা কি সত্যিই সেই কক্সবাজার? আমার তো বিশ্বাস হয় না।’

পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে ইনানী বিচে মা-বাবাকে প্রথমবার সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাই। সেখানে সূর্যাস্তের নরম আলোয় কেবল পাথর আর পাথর দেখে তাঁরা আর সাগরে নামার সাহস করেননি। পাথরের ওপর হাঁটাহাঁটি করেই চলে এসেছিলেন।

পরদিন যখন সমুদ্রে নিয়ে যাই, মা বালুর ওপর হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট শিশুর মতো উল্লসিত হতে থাকেন। কাছে তাকান, দূরে তাকান, কখনো নিচু হয়ে সাগরের জল স্পর্শ করেন, হাতের তালুতে নেন, গড়িয়ে পড়ে তাঁর কনুই বেয়ে, একটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমাকে বলেন, ‘মা রে, আমার কেমন জানি ঘোর লাগছে।’

এবার মা-বাবা দুজনকেই সমুদ্রস্নানে নামিয়ে দিই। কিছুটা চোখের আড়াল হই। দেখতে থাকি—পাশাপাশি নিবিড় হয়ে সাগরের দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁরা। মধুচন্দ্রিমা তো দুস্তর, তাঁরা জীবনে কোনো দিন পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করতে কোথাও যাননি। সমুদ্রের জলে পা ডুবিয়ে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে মা হয়তো বলেন, তুমি এত দিন এই অপার সৌন্দর্য আমাকে দেখাওনি কেন?

বাবা হয়তো চোখের ভাষাতেই বলেন, আমি তো আজকের দিনটার জন্যই অপেক্ষা করেছি, যেদিন তোমার-আমার সন্তানেরা মিলে আমাদের এই স্বপ্ন পূরণ করবে!

সাগর থেকে ফেরার পর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সমুদ্রভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিষয়ে তুমি কী বলবে বাবা?’ তাঁর উত্তর, ‘আমার জীবনটাই তো বদলে গেল রে মা।’

আর মা? তাঁর একটাই কথা, ‘আবার কবে সমুদ্রে যাব?’