লাশের ভিড়ে পাগলের মতো বাবাকে খুঁজতে থাকলেন মা

মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন অতুল চন্দ্র কর্মকার। ১৯৭১ সালের ২৪ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তিনি। শহীদ বুদ্ধিজীবী বাবাকে স্মরণ করলেন ছেলে বাসুদেব কর্মকার

শহীদ বুদ্ধিজীবী অতুল চন্দ্র কর্মকার
অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

১৯৭১ সালে আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল করছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বরিশাল শহর কেমন থমথমে হয়ে গেল। চারদিকে মানুষের কানাঘুষা—ঢাকায় কী যেন হচ্ছে! সবার মধ্যে কেমন একটা ভয়, আতঙ্ক। সে সময় স্কুলে যাই অনিয়মিত। একে বছরের শুরুর সময়, তার ওপর চারদিকে কেমন গুমোট পরিবেশ। স্কুলেও উপস্থিতি কম। আমার বাবা বিএম স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। আমরা থাকি নতুন বাজার এলাকায়। 

শিক্ষকতার পাশাপাশি বাবা রাজনীতিসচেতন ও সংস্কৃতিমনা মানুষ। বাবাকে ৭ মার্চের ভাষণের পর অনেকটা বিমর্ষ থাকতে দেখতাম। বোঝা যেত, ভেতরে-ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে তাঁর। এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

মে মাসে পাকিস্তানি সেনারা বরিশালে এসে ঈদগাহ এলাকা, নদীবন্দর এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় বোমা ফেলে, গুলি চালায়। কৌতূহল নিয়ে পরদিন তা দেখতে যাই। ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সেনাদের আনাগোনা, গোলাগুলির ঘটনা বেড়ে গেল। আতঙ্কে মানুষ শহর ছাড়তে লাগল। একদিন হঠাৎ বাবাও নিরুদ্দেশ হলেন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা গড়িয়ে গভীর রাত, তবু ফিরলেন না। নির্ঘুম রাত কেটে গেল। পরদিন মা (কনকলতা কর্মকার) আমাকে নিয়ে বের হয়ে বাবাকে হন্যে হয়ে খুঁজলেন। কিন্তু আমরা বাবার সন্ধান পেলাম না।

দুশ্চিন্তায় দিনের পর দিন কাটতে থাকল। এভাবে সপ্তাহখানেক পর হঠাৎ মা লোকমুখে জানতে পারলেন, বাবা ঝালকাঠি জেলার বাউকাঠি–সংলগ্ন আটঘর কুড়িয়ানায় আছেন। সেখানে বাবার কয়েকজন বন্ধু ও প্রাক্তন ছাত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে তিনিও যোগ দিয়েছেন। তত দিনে বরিশাল শহরের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা বেড়ে গেছে। 

বাসুদেব কর্মকার এখন
ছবি: সংগৃহীত

মা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আমাকে নিয়ে একদিন শহর ছেড়ে চলে গেলেন ঝালকাঠির নবগ্রাম এলাকার রামচন্দ্রপুর গ্রামে। সেখানে রশিদ মাঝি নামে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি ছিলেন। আমরা তাঁর বাড়িতে আশ্রয় পেলাম।

ঝালকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা এলাকাটি পেয়ারাবাগানের জন্য বিখ্যাত। পেয়ারাবাগানকে সুরক্ষাবর্ম হিসেবে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এ এলাকাকে ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ফলে এই কুড়িয়ানা ছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকার, আলবদরদের লক্ষ্যবস্তু। প্রতিদিনই এখানে গানবোট নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা গুলি চালাত। নিরীহ মানুষকে হত্যা করত। ইতিমধ্যে কয়েকটি সম্মুখযুদ্ধও হয়েছে।

২৪ মে ভোরেও এ রকম একটি ভয়ংকর সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।
মায়ের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। সেই যুদ্ধ দিনভর চলে। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট নিয়ে ক্যাম্পে চলে যায়। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর আমাকে নিয়ে কুড়িয়ানায় গেলেন মা। পৌঁছে দেখি, সেখানে অনেক শহীদের লাশ পাশের নদীতে, চরে, ডাঙায় পড়ে আছে। মা পাগলের মতো লাশের ভিড়ে অজানা শঙ্কা নিয়ে বাবাকে খুঁজতে থাকলেন।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে আটঘরে। খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে মায়ের শঙ্কাই সত্যি হলো। বাবাকে তিনি খুঁজে পেলেন। বাবার শরীর ঝাঁঝরা করে ফেলেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলি। তাঁর নিথর দেহ দেখে হতবিহ্বল মা। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না। কারণ, তখন সেখানে আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। অনেক মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। মা তখন পাগলের মতো উপস্থিত মানুষদের কাছে বাবার সৎকারের আকুতি জানাচ্ছিলেন। মায়ের আকুতিতে কয়েকজন সাড়া দিলেন। এরপর সনাতন ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী একটি কাঠি দিয়ে মুখাগ্নি করে বাবাকে সমাহিত করা হলো।

এরপর মা আমাকে নিয়ে নৌকায় করে কলকাতার উদ্দেশে ঝালকাঠি ছাড়েন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়েক দিন পর কলকাতায় পৌঁছে আমাদের আশ্রয় মেলে একটি শরণার্থীশিবিরে। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সেখানেই আমরা ছিলাম। এরপর ফিরে আসি বরিশালের বাড়িতে।

বছর দশেক আগে মা মারা গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বাবাকে হারানোর পর ৪০ বছরের বেশি সময় তাঁর স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন মা। এখন আমি আছি বাবার স্মৃতি বুকে আঁকড়ে। সেই স্মৃতি বেদনার, সেই স্মৃতি গর্বের।

গ্রন্থনা: এম জসীম উদ্দীন