চাকরি ছেড়ে হয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর, এখন মাসে আয় লাখ টাকার বেশি
লেখাপড়া শেষে পেশাজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা দিয়ে। এখন অবশ্য তাঁর পরিচয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে। ইউটিউবে তাঁর চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার প্রায় ১৮ লাখ। কেবল বাংলা কনটেন্ট দিয়েই তিনি জয় করেছেন মানুষের মন। তাঁর এমন ভিডিও-ও আছে, যেটি দেখা হয়েছে এক কোটিরও বেশি বার। বাংলাদেশে ইতিহাস, ভ্রমণ, তথ্যবহুল কনটেন্ট ক্রিয়েটরের কথা বলতে গেলে তাঁর নাম আসবে প্রথম সারিতে। বলছি সালাহউদ্দীন সুমনের কথা। বগুড়ার আদমদীঘির ছেলে সালাহউদ্দীন সুমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় পড়তে পড়তেই শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতা।
প্রথমে একটি পত্রিকায়, পরে যোগ দেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে। লেখাপড়া শেষ হলে রাজশাহীর পাট চুকিয়ে ২০১৩ সালে চলে আসেন ঢাকায়। ওই চ্যানেলেরই প্রধান কার্যালয়ে যোগ দেন প্রতিবেদক হিসেবে। ২০২১ সাল পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেছেন, পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন বিশেষ প্রতিনিধিও।
বাড়তি আয়ের খোঁজে
নিয়মিত চাকরির পাশাপাশি কীভাবে আরেকটু বাড়তি রোজগার করা যায়, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ভেবেছেন সুমন। তাঁর মনে হতো, অন্তত বাড়িভাড়ার ২০-২৫ হাজার টাকাও যদি বাড়তি আয় করা যেত, জীবন আরেকটু সহজ হতো। হঠাৎই একদিন ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে তাঁর মনে হয়, ইউটিউবার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর হলে কেমন হয়? ‘আমি যখন রাজশাহীতে ছিলাম, তখন দেখা যেত রিপোর্টিং তো করতামই, ক্যামেরাপারসন না থাকলে ভিডিওগ্রাফিও করতে হতো। তারপর সেই ভিডিও সম্পাদনা করে অফিসে পাঠাতাম। তো মনে হলো, স্ক্রিপ্ট লিখতে পারি, ভিডিও করতে পারি, ভয়েসওভার দিতে পারি, ভিডিও সম্পাদনা করতে পারি। তাহলে আমি কেন নিজের চ্যানেল খুলে কনটেন্ট তৈরি করতে পারব না?’
প্রস্তুতিপর্ব
তবে শুধু ভেবেই শুরু করে দেননি সুমন। টানা দুই মাস ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও দেখেছেন। মানুষ কোন ধরনের ভিডিও দেখতে চায়, কোন বিষয়ে আগ্রহ বেশি, কোন বিষয়টা নিয়ে কম কাজ হয়েছে, কারা কেমন কাজ করছেন—সবকিছু নিয়ে অনেকটা গবেষণাই করেছেন তিনি। তখন দেখতে পেলেন, অনেক মানুষ ভ্রমণবিষয়ক ভিডিও বানায়। কিন্তু সেসব ভিডিওতে কেবল কোনো একটি স্থানের কথা উঠে আসে। কিংবা কীভাবে সেখানে যেতে হবে, তার বর্ণনা। সেই স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা ইতিহাস কেউ বলে না। এই ভাবনা থেকেই সুমনের মাথায় আসে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কিছু করার। সে সময় ঢাকায় সিরাজউদ্দৌলার এক বংশধরের কথা বেশ আলোচনায় ছিল। সুমন ভাবলেন, সিরাজউদ্দৌলার বংশধরদের তো সবাই খোঁজে, কিন্তু মির জাফরের বংশের লোকজন এখন কোথায় আছেন, তাঁরা কারা? ইউটিউব বা গুগলে তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই পেলেন না তিনি। তাঁর মনে হলো, ভারতের মুর্শিদাবাদ গেলে হয়তো কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে। যে–ই ভাবা সে–ই কাজ। চার দিনের ছুটি নিয়ে ছুটলেন মুর্শিদাবাদ।
যেখানে বাঁকবদল
কাকতালীয়ভাবে মুর্শিদাবাদে সুমন যে হোটেলে উঠেছিলেন, তার মালিক কবি সলিল ঘোষ স্বয়ং মির জাফরের এক বংশধরের বন্ধু। কথায় কথায় সুমন তাঁকে বলেছিলেন মুর্শিদাবাদ সফরের কারণ। তখনই জানা গেল, তাঁদের বন্ধুত্বের কথা। সেই সফরে সুমন চেষ্টা করেছিলেন মির জাফরের বংশধরদের পরিচয় তুলে আনতে। এর রেশ ধরে কুষ্টিয়ায় থাকা কয়েকজন বংশধরকেও খুঁজে বের করে তাঁদের বক্তব্য প্রচার করেন।
মুর্শিদাবাদের সেই এক ভিডিওতেই সুমনের ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার বেড়ে যায় প্রায় ৭০ হাজার। ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে। সে সময় সুমন বেতন পেতেন ৫৫ হাজার টাকারও কিছু বেশি। ইউটিউব থেকে আয় তাঁর বেতনও ছাড়িয়ে যায়। একসময় হয়ে যায় দ্বিগুণ-তিন গুণ। তবে তখন সপ্তাহে একটি ভিডিওই প্রকাশ করতেন সুমন। যেদিন অফিস ছুটি থাকত, কেবল সেদিনই ক্যামেরা নিয়ে নিজের চ্যানেলের জন্য শুটিংয়ে বের হতেন। এর মধ্যেই সুমন যে চ্যানেলে কাজ করতেন, সেখান থেকে সব কর্মীকে জানানো হলো, টেলিভিশন সাংবাদিকতা এবং ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একসঙ্গে কাজ করা যাবে না। এর মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে। তখন সুমন যে বেতন পেতেন, তার চেয়েও বেশি আয় করতেন ইউটিউব থেকে। সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তাঁর বাবা এ সিদ্ধান্তে একমত হতে পারছিলেন না। শিক্ষক বাবা তাঁর সাংবাদিক ছেলের পেশা নিয়ে গর্বিত ছিলেন। আবার নিশ্চিত পেশা ছেড়ে ছেলে অনিশ্চিত কনটেন্ট ক্রিয়েশন বেছে নেবে, সেটাও মেনে নিতে পারছিলেন না।
অবশেষে চাকরিতে ইস্তফা
নানা যুক্তিতর্কের পর ২০২১ সালের জুলাইয়ে টেলিভিশন চ্যানেলের চাকরিটি ছেড়ে দেন সুমন। মজার ব্যাপার হলো, এরপরেই তাঁর ডাক আসে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে। সেখানে চাকরি করতে হলে ইউটিউবিং করা যাবে না, এমন কোনো শর্ত ছিল না। কাজের সময়ও বেশ সুবিধাজনক ছিল। তারপরও ৯ মাস পর এই চাকরিও ছেড়ে দেন সুমন। তিনি বলেন, ‘নতুন চাকরিতে কোনো শর্ত ছিল না। কিন্তু আমার মনে হলো, আমি যদি ইউটিউবিংই করতে চাই, তাহলে চাকরির পাশাপাশি হবে না। এটায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। তাই শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিই। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আমি পুরোপুরি কনটেন্ট ক্রিয়েটর।’
আয় কত
জানতে চেয়েছিলাম, সাংবাদিকতার সঙ্গে এখনকার উপার্জনের পার্থক্য সম্পর্কে। সুমন বললেন, ‘চাকরি করে যা উপার্জন করতাম, এখন তার চেয়ে ৭-৮ গুণ বেশি আয় করি। প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৩ লাখ টাকা আয় হয়, সর্বোচ্চ ১০ লাখও আয় করেছি। অর্থাৎ ৩-১০ লাখের মধ্যে থাকে মাসিক আয়। কখনো ৪ লাখ হচ্ছে তো কোনো মাসে ৭ লাখ।’
কীভাবে টাকাটা আসে, সে প্রসঙ্গে তিনি জানান, ইউটিউব থেকে টাকা আয়ের কিছু নিয়ম আছে। প্রথমে চ্যানেলটিকে মনিটাইজেশনের আওতায় পড়তে হয়। সে জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন ওয়াচ টাইম, মোট ভিউ ইত্যাদি। এ ছাড়া ইউটিউবের কোনো নিয়ম ভঙ্গ করা যাবে না। এরপর ইউটিউব মনিটাইজেশন চালু করে দেয়। তখন একটা ফরমে ব্যাংক ডিটেইলস, টিআইএন নম্বর ইত্যাদি লিখতে হয়। সেসব দেওয়ার পর প্রতি মাসের শেষ নাগাদ যে পরিমাণ আয় হয়, তা নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে পাঠিয়ে দেয় ইউটিউব কর্তৃপক্ষ।
এখন পর্যন্ত যেসব জায়গায় গিয়েছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কোন জায়গা, প্রশ্ন করি এই অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণপিয়াসীর কাছে। বললেন, গ্রাম তাঁর সব সময়ই পছন্দ। ক্যামেরার চোখ দিয়ে গ্রামবাংলা দেখতে ভালো লাগে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় স্থান রাজশাহীর ছোট চরখানপুর গ্রাম। পদ্মাপারের এই গ্রামের তিন দিকে ভারত। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় একেক রূপে ধরা দেয় গ্রামটি। এমনকি বর্ষাকালে সেখানে যেতে হলে ভারতীয় জলসীমা পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এ পর্যন্ত তাঁর চ্যানেলে চরখানপুরের ১৯টি ভিডিও আপলোড করেছেন সুমন। তাঁর নিয়মিত দর্শকেরাও বারবার গ্রামটি দেখতে চান, সুমনেরও কিছুদিন পরপর গ্রামটিতে না গেলে ভালো লাগে না।
ভবিষ্যতে চোখ
ভবিষ্যতেও কনটেন্ট ক্রিয়েশনই চালিয়ে যেতে চান কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দীন সুমন বলেন, ‘আপাতত বাংলাদেশ ও দুনিয়া ঘুরে দেখতে চাই। ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাই। তবে পাশাপাশি একটি প্রোডাকশন হাউস গড়ে তোলার ইচ্ছা আছে। এরই মধ্যে কথাচিত্র কমিউনিকেশন নামে প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করেছি। সেখান থেকে নিয়মিত তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা আছে।’
এ ছাড়া ‘সালাহউদ্দীন সুমন একাডেমি’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে অনলাইনে কনটেন্ট ক্রিয়েশনের ওপর কোর্স করানোর পরিকল্পনাও গুছিয়ে এসেছেন। যেখানে আগ্রহীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
নতুন যাঁরা কনটেন্ট ক্রিয়েশনে আসতে চান, তাঁদের উদ্দেশে সুমন বললেন, ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর হতে হলে নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কে কোন কাজ পছন্দ করেন, সেটা বুঝতে হবে। কেউ গান গাইতে পছন্দ করেন, কেউ রান্না করতে, কেউ মাছ ধরতে তো কেউ খাবারের রিভিউ করতে। যে যেটা পছন্দ করেন, সে ক্ষেত্রেই কাজ করা উচিত। তা না হলে কাজটা ভালো যেমন হবে না, সফলতাও আসবে না।’
সবশেষে সাংবাদিকতা ছেড়ে কনটেন্ট ক্রিয়েশন বেছে নিতে গিয়ে আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হয়েছিল কি না—জানতে চাইলে সালাহউদ্দীন সুমন বললেন, ‘এখন সবাই বুঝতে পেরেছেন যে আমার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। নতুন পরিচয়ে আমি খুব খুশি।’