এসির নিরাপত্তায় নজর রাখুন
গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষ ছুটছেন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) বিক্রয়কেন্দ্রে। দরদাম, ঘর ঠান্ডা হবে কি না, কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে—এসবের দিকেই ক্রেতারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এসি ব্যবহারে সচেতন না হলে দুর্ঘটনা বা নানা বিপত্তি ঘটতে পারে, এ বিষয়ে সচেতনতা এখন পর্যন্ত ততটা নেই। এসিতে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য কিছু প্রতিকারের ব্যবস্থাও আছে। তবে বিষয়গুলো কতজন মানছেন বা কতজন জানেন, সেই প্রশ্ন বারবার সামনে আসে এসি দুর্ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের কয়েকটি বিক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেল, দরদামের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকেই সুপরিচিত ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র থেকে এসি কিনছেন না। তার বদলে অনেক অখ্যাত বিপণিবিতান থেকে সুপরিচিত ব্র্যান্ডের লোগো বসানো এসি কিনছেন কম দামে। নিম্নমানের এসব পণ্যে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনো সেভাবে সরকারের নজরদারির আওতায় আসেনি বলেই জানান বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রের বিক্রয়কর্মী ও ব্যবস্থাপকেরা। তাঁরা বলছেন, সুপরিচিত ব্র্যান্ডের এসি নিয়ম মেনে ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কম। তাই আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে সচেতনতাটাই বেশি প্রয়োজন।
এলিট হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূর এ আলম প্রথম আলোকে বলেন, একজন ক্রেতা দাম দিয়ে এসি কিনছেন। কিন্তু তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ানের কাছ থেকে সেবা না নিয়ে নিচ্ছেন পাড়ার অদক্ষ কোনো টেকনিশিয়ানের কাছ থেকে। অদক্ষ টেকনিশিয়ান কোনো কিছু চিন্তা না করেই এসির জন্য যে গ্যাস ব্যবহার করতে হবে, তা না দিয়ে অন্য দাহ্য গ্যাস ভরে দিচ্ছেন। ফলে এসি ব্যবহারের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি নিজেদের টেকনিশিয়ানদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো দক্ষ টেকনিশিয়ানের সংখ্যা খুব কম। সরকারকে এ বিষয়টাতে নজর দিতে হবে।
মো. নূর এ আলম আমেরিকান সোসাইটি ফর হিটিং রেফ্রিজারেটিং অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং ইঞ্জিনিয়ার্সের (বাংলাদেশ চ্যাপটার) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বললেন, যাঁরা গাড়ি ব্যবহার করেন তাঁরা কিন্তু ছয় মাস পরপর গাড়ি সার্ভিসিং করাচ্ছেন। কিন্তু এসি নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত বেশির ভাগই এ বিষয়ে ভাবছেন না। অথচ বছরে একবার সার্ভিসিংয়ে খুব বেশি টাকা লাগে না। দুর্ঘটনার হাত থেকে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এসির মান পরীক্ষা ২০১৮ সাল থেকে বাধ্যতামূলক করেছে। ক্রেতারা একটি শ্যাম্পু কেনার সময়ও শ্যাম্পুর কৌটার গায়ে বিএসটিআইয়ের সিল আছে কি না, তা দেখছেন। কিন্তু এসি কেনার সময় বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না বলে উল্লেখ করে মো. নূর এ আলম বললেন, নিম্নমানের পণ্যে অনেক সময় সুপরিচিত ব্র্যান্ডের লোগো লাগানো থাকে। তবে পণ্যগুলো নকল। নকল পণ্যে বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন থাকবে না। এটা দেখলেই একজন ক্রেতা সচেতন হতে পারবেন। বেশির ভাগ ক্রেতা তা দেখছেন না বা এ অজ্ঞতা বা অসচেতনতাকে কাজে লাগিয়েই বাজারে নিম্নমানের এসি বিক্রি হচ্ছে। সরকারকেও এ দিকটাতে নজরদারি বাড়াতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, এসি ব্যবহারের পাশাপাশি এসি দুর্ঘটনায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও বাড়ছে। ঢাকা বিভাগে ২০২০ সালে এসি দুর্ঘটনায় ২৩টি, ২০২১ সালে ২৬টি এবং ২০২২ সালে ২৯টি অগ্নিকাণ্ডসহ মোট ৭৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মোট ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা) দিনমনি শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, এসির ব্যবহার বাড়ছে। একসময় বাসাবাড়ির ওয়্যারিং সিস্টেমে বাসায় শুধু ফ্যান ও লাইট চলত বা এর সঙ্গে ইস্ত্রির ব্যবহার হতো। এখন সেই বাসায় একাধিক এসি লাগানো হচ্ছে। বাসার বৈদ্যুতিক তার এসির জন্য যে লোড তা বহনের ক্ষমতা আছে কি না, তা বিবেচনা করা হচ্ছে না।
এসি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে ঘরের জন্য এসি ব্যবহার করা হবে তার আকার-আয়তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের কারওয়ান বাজার শাখার অপারেশন ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ক্রেতা যখন এসি কিনতে আসেন, তখন তিনি যে জায়গার জন্য কিনতে চাইছেন, তা কত বর্গফুটের তা জানতে চাওয়া হয়। সাধারণত ১২০ বর্গফুটের জন্য ১ টন, ১৫০ থেকে ১৬০ বর্গফুটের জন্য দেড় টন এবং ১৮০ থেকে ২২০ বর্গফুটের জন্য দুই টনের এসি কিনতে বলা হয়। যে জায়গার জন্য দেড় টনের এসি প্রয়োজন সেখানে ক্রেতা যদি এর চেয়ে কম টনের এসি কিনতে চান, তখন কমপ্রেসর ভালো কাজ করবে না। নানা জটিলতা দেখা দেবে।
মোহাম্মদপুরের এসক্যোয়ার ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের শোরুমের ব্যবস্থাপক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এসির যে ক্রেতা এই মাপজোখ মানতে চান না, তাঁদের কাছে এসি বিক্রি করা হয় না। কেননা, এতে এসির নানা সমস্যা চলতেই থাকে, একই সঙ্গে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে।