বাবার পথ ধরে আইবিএতে তিন বোন

বাবার সঙ্গে তিন বোন
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ সদস্যের পরিবারের চারজনই ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে পড়েছেন। এই চারজনেরই চাওয়া ছিল, তাঁদের মধ্যে ‘সবচেয়ে মেধাবী’ তানজিমা তাবাসসুম আলীও সেই পথেই হাঁটুক। কিন্তু তানজিমার পছন্দ যে মনোবিজ্ঞান! মা-বাবা একটু মন খারাপ করলেও মনোবিজ্ঞানেই স্নাতক করতে গত বছর মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় ভর্তি হন তিনি।

কিন্তু সেখানে মন টিকল না। এ বছর জানুয়ারিতে তাই দেশে ফিরে আসেন তানজিমা। সময়টা তাঁর জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলেন না। ‘বিদেশে টিকতে পারল না, দেশে পড়তে পারবে?’ অনেকের এমন মন্তব্য তাঁকে আরও দ্বিধায় ফেলে দেয়। তারপরও মায়ের উৎসাহে তিনি ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। মা শামীম আরা খানম বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষার তখন মাত্র ১১৩ দিন বাকি। এই সময়ে কঠোর পরিশ্রম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) সুযোগ পায় মেয়ে। মেধা তালিকায় ওর অবস্থান ছিল দশম। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ভর্তি–প্রক্রিয়া শেষ হবে।’

এরই মধ্য দিয়ে আইবিএর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনার সূত্রপাত হলো। কারণ, তানজিমার বাবা ও তিন বোনই আইবিএতে পড়েছেন কিংবা পড়ছেন। তানজিমা বলেন, ‘বাবার লিগ্যাসির (উত্তরাধিকার) অংশ হতে পেরে গর্ব হচ্ছে।’

তানজিমার বাবার নাম আরফান আলী। দুই বোনের মধ্যে বড় সিমরান তাবাসসুম আলী ২০২১ সালে আইবিএ থেকে বিবিএ করে এখন একটি ব্যাংকে চাকরি করছেন। আরেক বোন তাসমিয়াহ তাবাসসুম আলী পড়ছেন বিবিএ শেষ সেমিস্টারে। তিন বোনই স্কলাস্টিকা থেকে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের প্রাক্তন ছাত্রী মা শামীম আরা খানম ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকে উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।

এ পরিবারের সবারই পড়ালেখা ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে
ছবি: সংগৃহীত

তিন দশকের সম্পর্ক

আশির দশকে আর্থিক সংকটের মধ্যে দ্রুত সরকারি চাকরি পাওয়ার তাড়া থেকে আরফান আলী ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে, ডিগ্রি পাস কোর্সে। তবে বিকম পাসের পর আইবিএর এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ পান। এভাবেই তাঁর লক্ষ্য ও স্বপ্নে আসে বড় পরিবর্তন। আইবিএর চত্বরে দাঁড়িয়ে তরুণ চোখে দেখতে পেয়েছিলেন সুযোগগুলো এখানে অনেক অবারিত ও বিস্তৃত। সন্তানেরাও যে এক সময় তাঁরই পথ অনুসরণ করবে, তখন নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি। আরফান আলীর সঙ্গে কথা হয় ১৮ জুন রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএসে তাঁর অফিসে। গত বছরের আগস্টে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। এখন নিজের মায়ের নামে গড়েছেন প্রতিষ্ঠান জয়তুন পেমেন্ট গেটওয়ে। এ ছাড়া তিনি শপআপের নতুন উদ্যোগ অংকুর নামের একটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। দুটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যান তিনি।

জীবনে পরিমিতিবোধ রেখেছিলেন জানিয়ে আরফান আলী বলেন, কিশোর বয়সে বাবার মৃত্যু তাঁকে সংগ্রামের জীবনে ঠেলে দেয়। টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছেন। জীবনের এই লড়াই থেকেই চাপের মধ্যে কাজ করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। মেয়েদের সঙ্গে সেই গল্প প্রায়ই করেন। আরফান আলী বলেন, ‘আমি কখনো বিদেশে গিয়ে থিতু হতে চাইনি। মেয়েরাও বিদেশে পড়ুক, থাকুক চাইনি। সব সময় চেয়েছি, ওরা দেশে পড়ে দেশের জন্য কিছু করুক।’

‘লুসি গ্রে’ থেকে সত্যজিৎ, ছিল বাবার অনুপ্রেরণা

উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সেরা কবিতার একটি ‘লুসি গ্রে’। ঝড়ের রাতে মাকে পথ দেখিয়ে আনার জন্য লন্ঠন হাতে বের হওয়া লুসি গ্রে আর ঘরে ফিরতে পারেনি। মেয়েকে খুঁজে পেতে মা-বাবার ছোটাছুটি, হাহাকার, একদিন স্বর্গে দেখা হওয়ার প্রত্যাশা আর প্রকৃতির সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটির মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকার হৃদয়স্পর্শী কবিতা এটি। তানজিমার বড় বোন সিমরান বলেন, ‘৬ বছর বয়সে বাবা একদিন বললেন, লুসি গ্রে মুখস্থ করতে পারলে চায়নিজ খাওয়াতে নিয়ে যাবেন। আমিও করে দেখিয়েছিলাম। এভাবে উৎসাহ দিতেন বাবা। মাঝারি মানের ছাত্রী ছিলাম। বাবার কারণে আইবিএতে পড়তে ইচ্ছা হতো।’

আরেক বোন তাসমিয়াহ বলেন, ‘বাবার বিভাগের বিভিন্ন পুনর্মিলনীতে গিয়ে ইচ্ছা করত আইবিএতে পড়ি। যত বড় হয়েছি, বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব তত গাঢ় হয়েছে।’

সিমরান যোগ করেন, ‘শৈশব থেকেই আমাদের তিন বোনের হাতে বাবা শেক্‌সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, উপেন্দ্রকিশোর, সত্যজিতের বই তুলে দিয়েছেন। রামায়ণ-মহাভারত পড়েছি বাবার কাছেই। বাবা বলতেন, তোমরা অতিরিক্ত খরচ না করলে আরেকজন কিছু কেনার সুযোগ পাবে। এটা মাথায় এমনভাবে গেঁথে গেছে যে আমরা কেউ অযথা কোনো খরচ করতে পারি না।’

যা বললেন আইবিএর পরিচালক

বাবা ও তিন বোনের প্রসঙ্গে আইবিএর পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনের সঙ্গে কথা হলো। ২৯ বছর হলো তিনি আইবিএর শিক্ষক। জানালেন, তানজিমাদের মা শামীম আরা খানম তাঁর ছাত্রী ছিলেন, সেই সুবাদে পরিবারটি তাঁর পরিচিত। আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আইবিএর শিক্ষার্থী হিসেবে বাবা-ছেলে, তিন ভাই, তিন ভাই-বোন এমন দেখেছি। তবে আমার জানামতে, বাবা ও তিন মেয়ের আইবিএতে পড়ার সুযোগ পাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেনি। তবে আইবিএ প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা আছে কি না বলতে পারব না।’

আরও পড়ুন