ফুটবলের এই বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ দলের যে অভিজ্ঞতা হলো
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে গত সেপ্টেম্বরে হয়ে গেল হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ বা গৃহহীনদের বিশ্বকাপ। ফুটবলের এই আসরে প্রথমবার অংশ নিল ‘বাংলাদেশ হোমলেস টিম’। আটটি দলের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে সাতটিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ দল। এই দলের গল্প শোনাচ্ছেন নাজনীন আখতার
ভিসা না পাওয়ায় গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে খেলতে যেতে পারেনি বাংলাদেশ দল। এবারও ভিসা-জটিলতায় বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নটা ফিকে হয়ে এসেছিল। তাই প্লেনে চড়ার পরও খায়রুল আলমদের বিশ্বাস হচ্ছিল না সত্যিই তাঁরা খেলতে যাচ্ছেন! অভিজ্ঞতা না থাকায় প্লেন টেক-অফের সময়টাকে মনে হয়েছিল ‘বিকট শব্দ’ আর ‘ভয়াবহ’। দক্ষিণ কোরিয়ায় পা রাখার পরও মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছেন খায়রুল।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী খায়রুল। বাংলাদেশ হোমলেস টিমের গোলরক্ষক। বাগেরহাটে অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকে তাঁর পরিবার। স্কুল-কলেজে পড়ার সময় ক্লাসে যাওয়ার আগে সকালে ও ক্লাস থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে বর্গাজমিতে কাজ করতেন। এখনো ছুটিতে বাড়ি গেলে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজে যান। শৈশব থেকেই মাঠে কাজ করা এই তরুণ তাঁর প্রথম বিদেশযাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন।
খায়রুলের মতোই উচ্ছ্বসিত কুষ্টিয়ার সেলিম রেজা। জন্মগতভাবেই এই তরুণের ডান পা ছোট। এটা তাঁর দ্বিতীয় বিদেশযাত্রা। ২০২৩ সালে চীনের বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত প্যারালিম্পিকে অংশ নিয়ে হাইজাম্পে চতুর্থ হয়েছিলেন তিনি। এইচএসসি পাস সেলিম বছরে তিন-চার মাস শহরে এসে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। বাকি সময় দৌলতপুরে বাবার সঙ্গে গ্রামে মাছ ধরেন। তিনি বললেন, প্রস্তুতি হিসেবে শ্রীমঙ্গলে ক্যাম্প করে প্র্যাকটিস করছিলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় খবর আসে সবার ভিসা হয়েছে। জোরে হেসে সেলিম বলেন, ‘তখন কিসের আর প্র্যাকটিস! সবাই মিলে চিল্লাচিল্লি, নাচানাচি।’
২২ বছর বয়সী খায়রুল ও সেলিমদের মতো সাতজন খেলতে গিয়েছিলেন হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ বা গৃহহীনদের বিশ্বকাপে। তাঁরা ‘বাংলাদেশ হোমলেস টিম’-এর সদস্য। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের খেলার অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেনস (শি) এই দলের পৃষ্ঠপোষক। দলের সঙ্গে শি থেকেও গিয়েছিলেন চারজন।
হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপের এবারের আসরে অংশ নেয় বাংলাদেশসহ ৪০টি দল। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে ভিসা না হওয়ায় বাংলাদেশ ও নামিবিয়া মূল পর্বে খেলতে পারেননি। তবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, নামিবিয়ার সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে নামিবিয়ার সঙ্গে টাইব্রেকারে হারা ছাড়া বাকি সাতটিতেই জেতে বাংলাদেশ। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনাকে হারানোর সেই সুখস্মৃতি দলের প্রত্যেকের মুখে মুখে।
দলটির অন্য সদস্যরা হলেন সজীব কর, মিতুল শেখ, প্রেন চং ম্রো, ফুংলিয়ান কাপ বম ও অ্যালবার্ট কলিন্স ত্রিপুরা। নিজেরাই কাজ করে পড়াশোনার খরচ চালান এই প্রান্তিক তরুণেরা। খেলার সময় হলে এর মধ্য থেকেই সময় বের করে নেন।
হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ কী?
হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশন গৃহহীনদের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সেই সংজ্ঞা অনুসারে, বাড়িঘরহীন বা রাস্তায় ঘুমিয়ে রাত কাটানো ব্যক্তিরাই শুধু গৃহহীন নন, কোনো ব্যক্তির আবাসনে যদি পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকে, তাহলে তাঁকেও গৃহহীন ধরা হবে। কোনো ব্যক্তির আবাসন যদি তাঁকে নিরাপত্তা না দেয়, যদি তাঁকে উচ্ছেদ–আতঙ্কে বা হুমকির মধ্যে থাকতে হয়, আবাসনে যদি নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, রান্না ও খাবার মজুত করার মতো সুযোগ-সুবিধা না থাকে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে, তাহলে ওই ব্যক্তির আবাসন পর্যাপ্ত নয় বলে বিবেচনা করে ওই ব্যক্তিকেও গৃহহীন ধরা হবে। বিশ্বের ৭০টি দেশে ‘হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ’–এর সদস্য রয়েছে। ২০২২ সালে হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশনের সদস্যপদ পায় শি।
৪ ঘণ্টার আফসোস
হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপে বাংলাদেশ দলটির নেতৃত্ব দেন শির প্রতিষ্ঠাতা শারমিন ফারহানা চৌধুরী। কোচ ছিলেন জহিরুল হক। দলের ব্যবস্থাপক ছিলেন সংস্থার ক্রীড়া বিভাগের প্রধান পাপ্পু মোদক। ভিসা–জটিলতায় মূল পর্বে খেলতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর ভিসা পাওয়ায় মূল পর্বে খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে আয়োজকেরা দলকে র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা দলগুলোর সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার সুযোগ দেয়। সব কটি ম্যাচ ফিফা তাদের লাইভ প্লাস অ্যাপে সরাসরি সম্প্রচার করে। মোট ১৪ মিনিটের খেলায় প্রতি দলের চারজন করে খেলোয়াড় মাঠে খেলেছেন।’
হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপের মূল পর্বে মেক্সিকো চ্যাম্পিয়ন ও ইংল্যান্ড রানারআপ হয়েছে। শারমিন ফারহানা চৌধুরী বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমরা বিশ্বকাপে অংশ নিতে পেরেছি এবং লাল-সবুজ পতাকা বিদেশের মাটিতে ওড়াতে পেরেছি—এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খেলে সবার প্রশংসা কুড়ায় আমাদের দল।’
এই আয়োজনে সুখস্মৃতির কোনো অভাব ছিল না। হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফাউন্ডেশনের লেখক ইসোবেল ইরভাইন বাংলাদেশ দলকে নিয়ে একটি ফিচার করেছেন। তিনিও বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের ‘কাইজ্জা’ নিয়ে ওয়াকিবহাল। সেটাকে ভিত্তি করে তাই একদিন ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গের বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের দড়ি টানাটানি খেলার আয়োজন করেছিলেন। তাঁর ফিচারের সঙ্গে ছাপা হয়েছে সেই ছবি।
কোরীয় খাবার নিয়ে বেশ ভুগতে হয়েছে। খায়রুলের ভাষায়, ‘কী যে খেতে দিছিল, মুখেও দিতে পারতে ছিলাম না।’
ফুংলিয়ান বললেন, ‘সব কাঁচা কাঁচা। লবণ নাই।’
দুজনেই খুব হাসতে হাসতে বললেন, ৩০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় নেমে তাঁরা সবাই বিরিয়ানি খেতে ছুটেছিলেন।