নতুন পাঠক্রমে জীবনমুখী শিক্ষাকে কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে
নতুন পাঠক্রমের ভালো-মন্দ নিয়ে নানা প্ল্যাটফর্মেই কথা হচ্ছে এখন। বিশেষ করে সফট স্কিলের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বাইরের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় এই ধরনের দক্ষতা অর্জনের ওপর কতটুকু জোর দেওয়া হয়, জানতে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম দুবাইয়ের ইএনএআই ডব্লিউজি সেন্টার ফর একাডেমিক ইন্টিগ্রিটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ও ইউনিভার্সিটি অব ওলংগংয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. জিনাত রেজা খান-এর কাছে।
বিশ্বজুড়েই দেশভেদে চালু আছে ভিন্ন ভিন্ন কারিকুলাম। রয়েছে ভারতীয়, আমেরিকান, ব্রিটিশ জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক স্নাতক ব্যবস্থা। তবে সব কারিকুলামই এখন শিক্ষার্থীর বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখার চেয়ে সামগ্রিক বিকাশের ওপর জোর দিচ্ছে বেশি। একজন মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শুধু জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, চাই বহুমাত্রিক দক্ষতা। বিষয়টি উপলব্ধি করে সব শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিক্ষাবিদ এবং অভিভাবকেরা সামগ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন, যা বইয়ের চেয়েও একটু বেশি কিছু। সবার মধ্যেই এই উপলব্ধি আসছে যে নিয়ত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে মানিয়ে চলার জন্য একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক জ্ঞান ছাড়াও আরও বেশি কিছু প্রয়োজন। একটা সময় স্কুলগুলোয় শুধু বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখার ওপরই জোর দেওয়া হতো। আমরা পুরোনোরা (জেন এক্স), অর্থাৎ এখন যাঁরা অভিভাবক, তাঁদের অধিকাংশই বেড়ে উঠেছেন এই শিক্ষাব্যবস্থায়। এখন কিন্তু আর সেই দিন নেই। বিশ্বজুড়েই পরিবর্তন এসেছে। একজন অভিভাবক হিসেবেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার পদ্ধতি এবং বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য আমি দেখেছি। আমার জেন জেড কন্যা এখানকার বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার ভিন্ন ভিন্ন ধারার মধ্যে দিয়ে গেছে।
সর্বাঙ্গীণ পন্থা
শারীরিক কার্যক্রম এবং একাডেমিক অর্জনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ২০১৩ সালে স্কটল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিবিড় শরীরচর্চা টিনএজারদের ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞানবিষয়ক একাডেমিক দক্ষতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। শরীরচর্চা যে শুধু মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতারই উন্নতি করে, তা নয়; পাশাপাশি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বাড়ায়। যেসব একাডেমিক কাজ চমৎকারভাবে গুছিয়ে করতে হয় এবং যাতে নিজের অর্জিত জ্ঞানকে ব্যবহারিক রূপে প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে, সেগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতা অপরিহার্য।
কম্প্রিহেনসিভ অর্থাৎ সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ার ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনেক স্কুল শিশুদের সঙ্গে নিয়ে রান্নাবান্নার মতো কার্যক্রমও গ্রহণ করেছে। এটা যে শুধু স্বনির্ভরতার জন্যই প্রয়োজন, তা নয়; বরং রান্নাঘরের কাজগুলো নিরাপদে করার সু-অভ্যাস এবং খাবারের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার শিক্ষাও এই দক্ষতার মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়। এ ধরনের দক্ষতাকে অনেক সময়ই ‘সফট স্কিল’ বলা হয়, যা ক্লাসরুমের বাইরে পর্যন্ত বিস্তৃত। এ থেকে শিক্ষার্থীরা জীবনঘনিষ্ঠ মূল্যবান অনেক দক্ষতা অর্জন করে, যা তাদের রোজকার জীবনে কাজে লাগে।
কী কী ‘সফট স্কিল’?
আধুনিক কর্মক্ষেত্রে কারিগরি বা প্রযুক্তিগত দক্ষতার বাইরেও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। এখানে পারস্পরিক যোগাযোগ, সহযোগিতা এবং সমস্যা সমাধানের মতো বিভিন্ন ধরনের ‘সফট স্কিল’ প্রয়োজন হয়। তাই এ ধরনের দক্ষতাকে শিশুর শিক্ষাব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে অভিভাবকদের উৎসাহ দেওয়া হয়। ‘সফট স্কিল’ তৈরির মাধ্যমে শিশু ভবিষ্যতে তার ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবনের জন্য নিজেকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে পারে।
সহমর্মিতা, সহনশীলতা এবং আত্মসচেতনতার মতো নানান ‘সফট স্কিল’ একজন শিক্ষার্থীর আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে প্রভাবিত করে। ফলে একাডেমিক পারফরম্যান্সের ওপরও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিক্ষার্থী পারস্পরিক যোগাযোগে দক্ষ এবং দলগত কাজ করতে সক্ষম, যেকোনো আলোচনায় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, নিজের ভাবনা বা আইডিয়াকে কার্যকরভাবে উপস্থাপন করতে পারে এবং বিভিন্ন প্রজেক্টে অবিরাম সহযোগিতা করতে পারে। আমরা বারবার দেখেছি, খেলাধুলা বা সাঁতারের মতো কার্যক্রম বা শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখে, এমন যেকোনো কাজ, রান্নাবান্না এবং এ ধরনের অন্যান্য কার্যক্রম শিশুদের মধ্যে নানান ‘সফট স্কিল’ তৈরিতে সাহায্য করে।
এসবের বাইরেও অনেক ধরনের কার্যক্রম এবং বিষয় রয়েছে, যেগুলোকে সামগ্রিক বিকাশের অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব কাজ একজন শিক্ষার্থীর একাডেমিক যাত্রাপথকে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালিত করে। এ ধরনের কাজের মধ্যে রয়েছে নাটকের ক্লাস, বিতর্ক, নাচ, চিত্রাঙ্কন, নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি। এগুলোকে অনেক সময় ‘পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নিজের একাডেমিক দক্ষতাকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। এ ধরনের কাজে যুক্ত থাকাটা কিন্তু ক্লাসরুমের শিক্ষাকে একটি বাস্তবিক বিস্তৃতি দেয়। শিক্ষাকে মজবুত করে এবং শিক্ষার বিষয়গুলোকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে উৎসাহ দেয়। যেসব হাইস্কুল শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমে অংশ নেয়, তারা যেমন তাদের সামাজিক পরিসরকে বাড়াতে সক্ষম হয়, তেমনি নানা বিষয়ে তাদের আগ্রহও বাড়ে। নেতৃত্বগুণের মতো অপরিহার্য ক্ষমতাও অর্জন করে।
পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাবও ফেলে। একাডেমিক সাফল্য অর্জনের বাইরেও এ ধরনের কার্যক্রম তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
উচ্চশিক্ষার আবেদনে
উচ্চশিক্ষার দুনিয়ায় প্রবেশের সময় পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো একজন শিক্ষার্থীকে এমন একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়, যা তাঁদের আগ্রহ, ব্যক্তিত্ব এবং অর্থবহ অবদান রাখার ক্ষমতাকে উপস্থাপন করতে পারে। ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত থাকেন, একজন আবেদনকারীর এ ধরনের গুণকে তাঁরা গুরুত্ব দেন। যাঁরা তাঁদের অঙ্গীকারকে উপস্থাপন করতে পারেন, সময় ব্যবস্থাপনা এবং অনেক কাজের মধ্যে গুরুত্ব বুঝে কোনটা আগে করতে হবে, তা নির্ধারণ করতে পারেন, তাঁরাই যোগ্য বিবেচিত হন। এটা প্রায় অবধারিতভাবেই ধরে নেওয়া হয়, যাঁরা স্কুলে এবং সামাজিক পরিসরে এ ধরনের কাজে জড়িত ছিলেন, উচ্চশিক্ষার সময়ও তাঁরা সেগুলোর চর্চা অব্যাহত রাখবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা এ ধরনের আবেদনকারীদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
‘সফট স্কিল’ অভিভাবকদের উৎসাহ
অভিভাবকেরা শিক্ষাব্যবস্থায় ‘সফট স্কিল’ এবং পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যেহেতু একটি শিশু তার বিকাশকালে একটা বড় অংশ স্কুলে কাটায়, তাই এ ধরনের দক্ষতা শিক্ষা দিতে সক্ষম শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে অভিভাবকদের সক্রিয় সমর্থন দেওয়া উচিত।
শেষ কথা
একটি চমৎকার শিক্ষাব্যবস্থা আসলে বিষয়ভিত্তিক পড়ার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। অভিভাবকদের অবশ্যই তা বুঝতে হবে। ‘সফট স্কিল’ এবং পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রমের মাধ্যমেই শিশু তার ভবিষ্যৎ সাফল্য এবং নিজস্ব বিকাশের পথ খুঁজে পাবে। এমন না যে স্কুলে অভিভাবক নিজে যা পেয়েছেন, তা কখনোই বদলানো যাবে না। পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমেই একজন অভিভাবক তাঁর শিশুকে এই নিয়ত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে তুলতে পারেন। একটি শিশু তার বন্ধু এবং শিক্ষকদের সঙ্গে স্কুলে যে সময়টা কাটায়, তা তার বিকাশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেবল একাডেমিক জ্ঞানের জন্যই নয়, বরং তার সাফল্যমণ্ডিত এবং পরিপূর্ণ জীবনের জন্য এসব দক্ষতা অপরিহার্য।