‘বাংলা মাটি’ প্রচার চায় না
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের পথ ধরে এগোলে সুলতানগঞ্জের শুরু। সেখান থেকে ডানে কাদামাটির যে রাস্তাটা চলে গেছে, তার নাম বারৈখালী। সেই রাস্তায় নামলেই মনে হবে, আপনি ঢাকা নয়, মফস্বলে আছেন। দুই দিকের দোকানপাট আর চালচিত্র দেশের যেকোনো মফস্বলের সঙ্গে মিলে যাবে। দুজন সমবয়সী মেয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। একজনের চুল আবার বেণি করে লাল ফিতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। একটা বাচ্চা ছেলে চাইছে দুই টাকার লজেন্স। রাস্তার পাশেই ভাজা হচ্ছে গরম গরম জিলাপি আর ডালের বড়া। সেই রাস্তায় পা রেখে ঘড়ি ধরে দুই মিনিট নাক বরাবর হাঁটবেন। হাতের বাঁ পাশে পেয়ে যাবেন ‘বাংলা মাটি’।
কয়েক পা হাঁটলেই ‘বাংলা মাটি’র বিশাল দুটি গুদামঘর। একটার সঙ্গে আবার রয়েছে শোরুম। সেখানে শোভা পাচ্ছে মাটির তৈরি প্লেট, গ্লাস, জগ থেকে শুরু করে ঘড়ি, শোপিস, ক্রোকারিজ জিনিস, পুতুল, ফুলদানি—সবই! সেসবের গায়ে কতশত নকশা আঁকা। আর গুদামঘরের ভেতরে পত্রিকার পাতায় মোড়া শত শত মাটির তৈরি বাসনকোসন। তার ভেতর থেকেই উঁকি দিচ্ছে হাতি, ঘোড়া, মানুষের মুখ, দেবদেবীসহ নানা কিছু। লুকোচুরি খেলার জন্য এমন গুদামঘর তুলনাহীন।
সেখান থেকেই কয়েকটি এনে রাখা শোরুমে। যাতে ক্রেতাদের পছন্দ করতে সুবিধা হয়। আমরা গিয়েছি মাটির ডিনার সেট কিনতে। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও জিনিস বিক্রি করতে বিশেষ আগ্রহ দেখাল না অল্পবয়সী ম্যানেজার রতন মিস্ত্রি। দেখাবেই–বা কেন, প্রতিদিন লাখ টাকার বেচাকেনা হয় এই মধ্যবিত্ত মলিন চেহারার গুদামঘরে। শাঁখারী বাজার, আড়ং বা দোয়েল চত্বরের বাজার থেকে শুরু করে ঢাকার যেখানে যেখানে মাটির জিনিস বিক্রি হয়, বুঝবেন ‘বাংলা মাটি’ থেকেই এসেছে। কেবল ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় মাটির জিনিসপত্র সরবরাহ করে তারা।
অবশ্য কিছুক্ষণ পর নানা আলাপে অনেকটাই সহজ হয়ে এলেন ‘বাংলা মাটি’র লোকজন। আন্তরিকভাবে গল্প করলেন, নিজে থেকেই দিলেন নানান তথ্য। তবে মাসে কত টাকার জিনিস বিক্রি হয়, সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। মাথা চুলকে বললেন, ‘কে জানে! হিসাব নাই। একেক মাসে একেক রকম।’
বাংলা মাটি শুরুতে ছিল পটুয়াখালী। সেখান থেকেই এর উদ্যোক্তা বিশ্বেশ্বর পাল ব্যবসা প্রসার করতে নিয়ে আসেন ঢাকায়। তা–ও প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। এখন ব্যবসার হাল ধরেছেন তাঁর ছেলে শিশিরকুমার পাল। তিনি দোকানে ছিলেন না। এই ব্যবসার শুরুর গল্প শুনতে তাঁর কাছে ফোন করলে বললেন, ‘দেখেন, আমরা প্রচারণা চাই না। এমনিতেই যত অর্ডার আসে, সাপ্লাই দিতে হিমশিম খাই। এর ভেতর বছর পাঁচেক হলো যোগ হইছে আনলাইন উদ্যেক্তারা। এদের সংখ্যা বাড়তেই আছে। এত মাল আমরা কীভাবে দেব? অত লোকবল নেই। আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) আমার বাড়িতে মনসাপূজা। কয়েকজন লোক খাওয়াব। ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলি।’
একসময় দেশে মাটির তৈরি জিনিসপত্রকে দেখা হতো একটু বাঁকা চোখে। মাটির বাসনকোসন যেন কেবল দরিদ্রদের ঘরের পণ্য। অথচ সময়ের সঙ্গে এখন আধুনিক রুচিশীল মধ্যবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্তের ঘরে শোভা পায় মাটির তৈরি তৈজস। আর সেই চাহিদা তৈরিতে অবদান রেখেছে ‘বাংলা মাটি’। বিশ্বেশ্বর পালের বাবা–দাদারাও যুক্ত ছিলেন মাটি দিয়ে নানা কিছু তৈরির সঙ্গে।
ক্রমে ক্রমে সেটি দেশের মাটির তৈরি জিনিসপত্রের সবচেয়ে বড় আধারের একটিতে রূপ নিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে চারুকলার একঝাঁক ডিজাইনার। ফলে পৈতৃকসূত্রে যাঁরা মাটি দিয়ে নানা কিছু তৈরির সঙ্গে যুক্ত, আর যাঁরা শিখেছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে—দুই পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা মাটি।
একটা প্লেট ধরতেই একজন বললেন, ‘এটা কুষ্টিয়ার তৈরি। লালনের দেশে মাটির কাজ ভালো হয়।’ শুনে বললাম, ‘আপনারা মাল কেনেনও?’ বললেন, ‘হ্যাঁ, কয়েকটা জায়গা থেকে মাল নিইও।’ আমাদের ভেতর একজন কুষ্টিয়ার শুনে তাঁকে কুষ্টিয়ার বানানো একটা হাতিও উপহার দিলেন।
কেনাকাটা শেষে চলে আসার সময় কী মনে করে বললেন, ‘আবার আইসেন। নম্বর তো আছেই। ফোন দিয়ে চলে আইসেন।’