মোড়কজাত খাদ্যপণ্যে যেভাবে ‘দেশি’ ব্র্যান্ড এগিয়ে গেল
চাল, ডাল, আটা, ময়দা থেকে শুরু করে তেল, দুধ—‘পাকা’ বাজারের সবই যেন এখন প্যাকেটে বন্দী। খোলাবাজারে বেচাবিক্রি থাকলেও অনেকেই বেছে নেন প্যাকেটজাত ভোজ্যপণ্য।
দেশের বাজারে প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের প্রসারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর। বাজারে প্যাকেটজাত খাদ্যের বড় অংশ দখল করে রেখেছে দেশি শিল্পগোষ্ঠীগুলো।
একটা সময় ছিল, যখন দেশি খাদ্যপণ্য কিনতে চাইলে খোলাবাজারে পা দিতেই হতো ভোক্তাদের। মোড়কজাত পণ্যের বাজারে আধিপত্য ছিল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের। আমদানি করেই এসব পণ্যের চাহিদা মেটাতে হতো। সেই চিত্র বদলে গেছে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। বাজারে প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যের প্রায় পুরোটাই দখল করে আছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। ফ্রেশ, স্কয়ার ফুড, এসিআই, প্রাণ ও রিদিশার মতো উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের অবদানই বেশি।
প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য মূলত দুই প্রকার। ‘রেডি টু কুক’ আর ‘রেডি টু ইট’। রেডি টু কুক পণ্য বাজার থেকে কিনে নিয়ে সরাসরি রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, লবণ ইত্যাদি। আর রেডি টু ইট পণ্য বাজার থেকে কিনেই খেয়ে ফেলা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বিস্কুট, কেক, চানাচুর–জাতীয় খাদ্য। দেশি কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রভাব কমবেশি বিস্তার করছে দুইদিকেই।
বেশির ভাগ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানই প্যাকেটজাত খাদ্যকে বাজারে এনেছে আলাদা ব্র্যান্ড নামে। সেই নামটাই ঘোরে মানুষের মুখে মুখে। মসলার বাজারে পরিচিত নাম রাঁধুনী মসলা যেমন স্কয়ার ফুডের পণ্য। তেমনি চাষী চিনিগুঁড়া চালও স্কয়ারের। আবার মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) ফ্রেশ নামে এনেছে প্যাকেটজাত পণ্য। ফ্রেশ তেল, দুধ—সবই এমজিআইয়ের পণ্য। জনপ্রিয় তীর আটা, ময়দা, সুজি আবার সিটি গ্রুপের পণ্য। এদিক থেকে একটু ব্যতিক্রম এসিআই ও প্রাণ।
বাজারে তারা প্রতিষ্ঠানের নামেই পরিচিত। এসিআই লবণ নামে ও গুণে অনেক দিন ধরে বাজারে জনপ্রিয়। প্রাণ অবশ্য নিজেদের প্রসার ঘটিয়েছে ‘রেডি টু ইট’ পণ্যের দিকে। বিস্কুট, ড্রাই কেক, আচার, ক্যান্ডি–জাতীয় পণ্যের বিশাল তালিকা তাদের।
একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্য যেমন দেখা যায় বাজারে, তেমনি একই পণ্য বাজারে নিয়ে এসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। চিনিগুঁড়া সুগন্ধি চালের কথাই ধরা যাক, বাজারে চাষী, ফ্রেশ, এসিআই, তীর—প্রত্যেকেই নিজেদের আলাদা আলাদা পণ্য নিয়ে এসেছে। একই ঘটনা দেখা যায় মসলা, লবণ থেকে শুরু করে রান্নায় ব্যবহৃত প্রতিটি পণ্যের বেলায়।
বাজারে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে গুণগত মান যেমন বেড়েছে, তেমনি দামও থাকছে ক্রেতাদের হাতের নাগালে। এর পাশাপাশি মোড়কের নকশা ও মানে দিন দিন উন্নতি করেছে দেশি ব্র্যান্ডগুলো।
দাম কেমন
বাজারে একই পণ্যের দামের দিকে তাকালেই বোঝা যায় দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই ঠিক কী রকম প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিষ্ঠানভেদে কেজিপ্রতি চিনিগুঁড়া সুগন্ধি চালের দাম ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। আবার নাজিরশাইল চালের ৫ কেজি প্যাকেটের মূল্য ৫০০ টাকার আশপাশে। ৫ লিটার সয়াবিন তেলের বোতল প্রতিষ্ঠানভেদে ৮১০ থেকে ৮২০ টাকা। ১ কেজি আটার মূল্য ৫৫ থেকে ৭০ টাকা, ১ কেজি আয়োডিনযুক্ত লবণের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।
বিভিন্ন কোম্পানির চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকা কেজিতে। তবে ভিন্নতা দেখা মেলে ডালের বাজারে। প্রতিষ্ঠানভেদে এক কেজি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। খোলাবাজারের মতো প্যাকেটজাত পণ্যে প্রতিদিন দাম ওঠানামা করে না। ক্ষেত্রবিশেষে দাম প্রায় একই রকম থাকে। যে কারণে ক্রেতাদের আস্থার জায়গাটা থাকে অটল।
মানের কারণে ক্রেতাদের আস্থা
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে গুণগত মান আর বিশুদ্ধতা দিয়ে। খোলাবাজারের পণ্য মানেই ধুলাবালু, জীবাণু—কত কত ভয়। প্যাকেটজাত পণ্যে নেই সে রকম কোনো ভয়। বরং খাবারের গুণাবলি থেকে শুরু করে বিশুদ্ধতা, সব জায়গাতেই গুণগত মান নিশ্চিত করে কোম্পানিগুলো।
মোড়কজাত পণ্য বাজারে ছাড়ার আগেই নিতে হয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) সনদ। স্বাস্থ্যসচেতন যে কেউই তার খাদ্যপণ্যের ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকে বলে রিদিশা ব্র্যান্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে প্যাকেটজাত খাবারেই আস্থা খুঁজে পেয়েছেন ক্রেতারা। বাইরের খাবারে যে স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয় থাকে, প্যাকেটজাত খাবারে সেই দুশ্চিন্তা থাকে না। রিদিশার প্রতিটি পণ্যের গায়েই বিএসটিআই, হালাল ও আইএসও-এর ভিন্ন ভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সনদ থাকে। গুণগত মানের একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারলে এই সনদ অর্জন করা সম্ভব হয় না।
প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) তোষন পাল বলেন, নব্বইয়ের দশক থেকেই মূলত প্যাকেটজাত পণ্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ভোক্তারা। শুরুটা হয়েছিল মসলা দিয়ে। ধীরে ধীরে আটা, ময়দা থেকে এখন সব পণ্যই প্যাকেটে পাওয়া যায়। এই পরিবর্তনটা এক দিনে আসেনি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তারা নিজেদের ভালোর কথা মাথায় রেখেই প্যাকেটজাত পণ্য ব্যবহার শুরু করেছেন। বাজারে প্রতিযোগিতা যত বেশি থাকবে, ক্রেতাদের জন্য তত ভালো। ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একই পণ্য থাকা মানেই ভোক্তাদের সামনে বিকল্প তৈরি হওয়া। এতে করে বাজারে যেমন কেউ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না, তেমনি গুণগত মানের দিক থেকেও বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা লড়াই থাকে।
শুধু বিশুদ্ধতা নয়, খাবারের পুষ্টিগুণ, উপকরণ থেকে শুরু করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ—সবকিছুর উল্লেখ থাকে প্যাকেটের গায়ে। তাই কেনার আগে নিজে যাচাই করে নেওয়ার সুযোগও থাকে ক্রেতাদের কাছে।
তবে প্যাকেটজাত পণ্য হাতে নেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে নেওয়াও প্রয়োজন। প্যাকেটের গায়ে থাকা মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ, ‘বিএসটিআই’-এর লোগো দেখেই তবে কেনা উচিত।