বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে দেশি ফ্যাশনশিল্প
এক নজরে দেশী পোশাকের বাজার
দেশি ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের সংগঠন এফইএবি—ফ্যাশন উদ্যোগ ২০১৮ সালে একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনের তথ্যমতে— ১৯৭৩ থেকে ২০১৮—এই ৪৫ বছরে দেশি ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।
ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হাউসের সংখ্যা প্রায় ১০০।
২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশি ফ্যাশন হাউসের শাখার সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ।
বর্তমান দেশি পোশাকশিল্পে বার্ষিক ব্যবসা কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে ফ্যাশন হাউসের শুরুটা উৎসব ও দিবসভিত্তিক পোশাক তৈরির মাধ্যমে। এমনকি এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে ফ্যাশন হাউস বলতে এতিহ্যবাহী উদ্যোগগুলোকে বোঝায়। এক দশক আগেও এর বাইরে যাঁরা তৈরি পোশাক নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের খুব বেশি আমলে নেওয়া হতো না। কিন্তু এই এক দশকে দেশীয় ফ্যাশনশিল্পে ঘটে গেছে বেশ বড় এক পরিবর্তন। ঐতিহ্যবাহী ফ্যাশন হাউসগুলোর পাশাপাশি তৈরি পোশাকের ‘রেডি-টু-ওয়্যার’ ব্র্যান্ডগুলো বেশ জোরালোভাবে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। এর পেছনে কারণও অনেক। বড় ভূমিকা পালন করেছে
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ও বৈশ্বিক নানা পটপরিবর্তন। তবে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন পোশাক–আশাকনির্ভর দেশি ফ্যাশনশিল্পের গোড়াপত্তনের দিকে।
একাত্তর পরবর্তী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, দেশি ফ্যাশনশিল্প শুরু করেন আশরাফুর রহমান ফারুক ‘নিপুণ ক্র্যাফটস’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এরপর ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৭৮ সালের শেষভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আড়ং’। এরপর ‘টাঙ্গাইল শাড়ী কুটির’।
আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকে দেশের মানুষের সামনে হাজির হয় বেশ কয়েকটি ফ্যাশন হাউস। যেগুলোর বেশির ভাগ এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এ তালিকায় রয়েছে কে-ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, রঙ, সাদাকালো, বিবিআনা, বাংলার মেলা ইত্যাদি। বলা যায়, সে সময় তৈরি হয় একধরনের গণজোয়ার। যেকোনো ধর্মীয় উৎসব ও জাতীয় দিবসগুলোয় মানুষের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠে দেশি ফ্যাশন হাউসের তৈরি পোশাক। যে ধারা এখনো অনেকটা অব্যাহত। তবে মানুষের চাহিদা ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ছোট–বড় ফ্যাশন হাউস।
নতুন শতকের প্রথম দশক থেকে প্রযুক্তির অগ্রগতি ও বৈশ্বিক যোগাযোগ সহজ হতে শুরু করায় ক্রেতার চাহিদায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। উৎসবভিত্তিক পোশাকের বাইরে সে সময়ের তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়তে থাকে চলতি ধারা (ট্রেন্ডি) এবং নিত্যদিনের ফ্যাশনেবল পোশাকের প্রতি। বলা যায়, রেডি–টু–ওয়্যারের এই বাজার ধরতেই পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর আলোকে দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড তৈরিতে সচেষ্ট হন আরএমজি বা তৈরি পোশাকশিল্পের কুশীলবেরা।
যদিও এই প্রচেষ্টাকে একেবারে নতুন বলা যাবে না। কারণ, সেই আশির দশকের মাঝামাঝি গড়ে ওঠা পিয়ারসন্সকে বলা যেতে পারে এই ধারার পথিকৃৎ। সে সময় ব্র্যান্ডটি জনপ্রিয়তাও কুড়িয়েছিল বেশ। এরপর শুধু পুরুষের তৈরি পোশাক নিয়ে আসে ক্যাটস আই। সোল ডান্স, আর্টিস্টি, ইয়েলো, একস্ট্যাসির মতো ব্র্যান্ডগুলোর নাম যোগ হয় একে একে।
এরই ধারাবাহিকতায় অল্প সময়ের ব্যবধানে আত্মপ্রকাশ করে লা রিভ ও সেইলর। এই পালে পরে যোগ হয় জেন্টল পার্ক, এমব্রেলা, ক্লাবহাউজ, সারা, টুয়েলভসহ আরও কিছু ফ্যাশন ব্র্যান্ড। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকবে, এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে। কারণ, বাজারে রয়েছে চাহিদা ও উপযোগিতা। বাজারও যথেষ্ট বড়। অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা যায়, দেশি ফ্যাশনশিল্পের বার্ষিক ব্যবসার (টার্নওভার) পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
ফ্যাশন হাউস লা রিভের প্রধান নির্বাহী পরিচালক মন্নুজান নার্গিস বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে বলতে হয়, এখন আমাদের দেশের ক্রেতা বা ফ্যাশনসচেতন মানুষকে শুধু আধুনিক বললে ভুল হবে। বলতে হবে, তাঁরা সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। তাঁদের রুচিবোধের জায়গাটা তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবেই। একসময় শুধু উৎসবভিত্তিক এথনিক পোশাকের চাহিদা বেশি ছিল। বর্তমানে এর পাশাপাশি চলতি ধারা, অর্থাৎ ট্রেন্ডি ও আরামদায়ক পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে এ সময়ের তরুণ–তরুণী বা জেন–জিরা আন্তর্জাতিক ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়।
আমরাও এখন একটি সংগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এমনকি আন্তর্জাতিক ফ্যাশন সপ্তাহে জনপ্রিয় হওয়া ধারাগুলো অনুসরণ করে দেশি ভঙ্গিমায় পোশাকের সংগ্রহ উপস্থাপন করতে হয়। হোক তা উৎসব বা ঋতুভিত্তিক। আবার কিছু পশ্চিমা পোশাক এখন অনেকটাই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। যেমন টপ ও কুর্তা। আমাদের দেশের মেয়েরা এই পোশাক এখন নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যমতো পরছে। এর মানে এই নয় যে ঐতিহ্যবাহী বা এথনিক পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। সব ধরনের পোশাকই সবাই বেছে নিচ্ছে।’
তবে করোনা মহামারির সময় সারা পৃথিবীর মতো ব্যবসায়িক মন্দার শিকার হয় দেশি পোশাকশিল্প। রঙ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস বলেন, ‘করোনার পর অনেক হাউসই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। গত ৩–৪ বছরে দেশি ফ্যাশন হাউস ঘুরে দাঁড়ালেও আমরা যে স্বস্তিতে আছি, তা নয়। আগের মতো স্বাভাবিক হতে আরও সময় লাগবে। দেশের পোশাক বাজারে দেশি ফ্যাশন হাউসের বার্ষিক টার্নওভার কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা হবে।’
গয়নায় দেশি সৃজনশীল ধারা
দেশি ফ্যাশন শুধু পোশাকেই সীমাবদ্ধ নেই; এর শাখা ছড়িয়েছে অনুষঙ্গের নানা ধারায়ও। এর মধ্যে দেশি গয়নার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন হাউসগুলোর পাশাপাশি অনেক উদ্যোগও কাজ করছে বেশ ভালোভাবে।
কয়েক দশক আগে দেশি ঐতিহ্য ও উপকরণের গয়না বলতে শুধু আড়ংকেই বোঝাত। উৎসবে ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সাঙ্গে নান্দনিক গয়নার ঠিকানা হয়ে ওঠে দেশি ফ্যাশন হাউসগুলো। এই সময়ে এসে সিক্স ইয়ার্ডস স্টোরি, গ্লুড টুগেদার, রঙ্গবতী, তাশা, ঋ, মৃৎ, শক্তি, যাত্রা, তাসার মতো অনেক ছোট–বড় উদ্যোগ কাজ করছে নানা উপাদানের দেশি গয়না নিয়ে। যে উদ্যোগগুলোর কাজে রয়েছে স্বকীয়তা। এমনকি তাদের হাত ধরেই গয়নার ধারায় এসেছে ভিন্নতা।
একুশ শতকের এই সময়ে গয়নার ধারা আর আটকে নেই নির্দিষ্ট কোনো নকশা বা উপকরণে। ধাতব, কাঠ, কড়ি, মাটি, রুদ্রাক্ষ বা পুঁতি—সবকিছু দিয়েই তৈরি হচ্ছে গয়না। নানা ধরনের গয়না এখন পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছেন ফ্যাশনিস্তারা। তবে ট্রেন্ড যদি বলতেই হয়, এখন ভারী গয়নার চেয়ে হালকা ওজনের মিনিমাল কাজের গয়নাই বেশি পছন্দ সবার। আর এই বাজারও বেশ বড়।