স্প্যানিশ দুই তরুণকে সঙ্গে নিয়ে যেভাবে লাইব্রেরি গড়েছেন আরাফাত
সুন্দরবনের কোলঘেঁষা দাকোপ উপজেলার নলিয়ান গ্রামে ছোট পরিসরে একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন আরাফাত হোসেন। সেটা করোনাকালের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর ইচ্ছা ছিল, তাঁর লাইব্রেরিটা আরও সুন্দর করে সাজাবেন। স্প্যানিশ দুই তরুণ কীভাবে আরাফাতের এই স্বপ্নের সঙ্গী হলেন?
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে শিবসা নদী। এই নদীর তীরেই নলিয়ান। খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নে এ গ্রাম। ইউনিয়নটিতে ৪০ হাজারের বেশি মানুষের বাস, যাঁদের অধিকাংশই বনজীবী। অর্থাৎ সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া, মধুর ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন এই এলাকারই সন্তান। নিজেকে সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন তো ছিলই, পাশাপাশি আরাফাত ভাবছিলেন, কেমন করে এই জনপদের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করা যায়?
শুরুটা হয় করোনাকালে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। গ্রামে এসে আরাফাত দেখেন, অধিকাংশ তরুণ মোবাইল গেম, পাবজি-ফ্রি ফায়ারে আসক্ত। আরাফাতের মনে হলো, গ্রামে লাইব্রেরি বা বিনা মূল্যে বই পড়ার মতো জায়গা থাকলে হয়তো এই দুরবস্থা দেখতে হতো না। যেই ভাবা, সেই কাজ।
শিবসার তীরে নলিয়ান লঞ্চঘাটে গড়ে উঠল আরাফাতের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এখানে দীর্ঘসময় লঞ্চ, ট্রলার বা খেয়া নৌকার অপেক্ষায় থাকেন মানুষ। আরাফাত ভাবছিলেন, এই সুযোগে যদি তাঁদের কিছু বই পড়ানো যায়, মন্দ কী। উদ্যোগের সঙ্গে যোগ দেন গ্রামের সাত তরুণ—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশিকুর রহমান, খুলনার আযম খান সরকারি কমার্স কলেজের তৌফিক হাসান, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের রাহাদ ইসলাম, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির মাহবুবুর আলম, কপিলমুনি কলেজের তৌফিকুর রহমান, বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম ও নলিয়ান দারুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক এইচ এম রানা। সবার শ্রম ও অর্থে দুই দিনে শেষ হয় নির্মাণকাজ। ২০২১ সালের ১০ মে হয় উদ্বোধন।
আমরা পাশে আছি
বইয়ের পাতায় আলো খুঁজি—এই প্রতিপাদ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ভ্রাম্যমাণ ‘মানবিক লাইব্রেরি’। শুরুতে বই ছিল কেবল ২২টি। ধীরে ধীরে লাইব্রেরির নাম ছড়াতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকে বই ও আর্থিক সহায়তা।
এরই মধ্যে দুই স্প্যানিশ পর্যটক অ্যাবেল অ্যাটারিস ও পাবলো বেসকোসের সঙ্গে আরাফাতের পরিচয়। ২২টি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে এসেছিলেন তারা। ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর, দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেটে তাঁদের সঙ্গে আরাফাতের প্রথম দেখা। পরের তিন দিন দুই অতিথি বিশ্ববিদ্যালয়েই থেকেছেন, ঘুরেছেন ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গা। এক সময় তাঁরা আরাফাতের সঙ্গে চলে যান নলিয়ান। তারপর? আরাফাত বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির জন্য কিছু বই এনেছিলাম। যখন তাঁরা দেখল, সঙ্গে আনা বইগুলো লাইব্রেরিতে রাখছি, কৌতূহলী হয়ে বিস্তারিত জানতে চাইল। সব শুনে আইডিয়াটা তাঁদের খুব পছন্দ হলো। বলল, “আরাফাত, এই লাইব্রেরি নিয়ে তোমার স্বপ্ন কী?” জানালাম, “আমার স্বপ্ন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিটিকে স্থায়ী লাইব্রেরিতে রূপ দেওয়া।” তখন তাঁরা বলল, “চিন্তা কোরো না, আমরা তোমার পাশে আছি।” সবকিছু শুনে আমার বাবা এক শতাংশ জমি দিতে রাজি হয়ে গেলেন। লাইব্রেরি নির্মাণে আর বাধা রইল না।’
স্থায়ী রূপে মানবিক লাইব্রেরি
এক মাসের ভিসায় বাংলাদেশে এসেছিলেন পাবলো ও অ্যাবেল। ২০ দিন পেরিয়ে গেছে। তড়িঘড়ি শুরু হয় লাইব্রেরি নির্মাণের কাজ। দুই বিদেশি পর্যটকও নির্মাণকাজে সরাসরি অংশ নেন। মানবিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আরাফাত হোসেন বলেন, ‘লাইব্রেরি গড়তে আমাদের মোট ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭৫ ইউরো, অর্থাৎ ১ লাখ ৪ হাজার ২৩৫ টাকাই (তৎকালীন সময়ের টাকার মান অনুযায়ী) অ্যাবেল ও পাবলোর দেওয়া। এসব টাকায় ইট, রড, সিমেন্ট, বালি, টিন, খুঁটি, কাঠ, রং, বই ইত্যাদি কেনা হয়েছে। মিস্ত্রিদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর লাইব্রেরির প্রাথমিক নির্মাণ শেষ হলে নতুন করে এর উদ্বোধন হয়।’
আলো ছড়াচ্ছে মানবিক লাইব্রেরি
মানবিক লাইব্রেরিতে এখন ২০৬টি বই ও সাময়িকী আছে। খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে যে কেউ বই নিয়ে যেতে পারে, পরে ফেরত দিয়ে নতুন বই নিতে পারে। এরই মাধ্যমে গ্রামবাসীর মধ্যে পাঠাভ্যাস তৈরি হচ্ছে।
নলিয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র রাহিদুল ইসলাম যেমন জানাল, ‘আগে আমরা স্কুলের বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়তে পারতাম না। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ধরনের বই পাচ্ছি।’
আরাফাতের বাবা নুরুল ফকির পেশায় কৃষক। লাইব্রেরির জন্য জমি দিয়েছেন, পাশাপাশি দেখাশোনাও তিনিই করেন। জানালেন, লাইব্রেরিটি গ্রামের কিশোর-তরুণদের মানসিকতায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে শুরু করেছে।
শুরু থেকেই মানবিক লাইব্রেরির সঙ্গে আছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘লঞ্চঘাটে যখন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়, তখন আমরা নিজেরাই কাঠমিস্ত্রির কাজ করেছিলাম। কত রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। কেউ সাধুবাদ জানিয়েছে, কেউ কটাক্ষও করেছে। আমরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে লেগে থেকেছি। দুঃখের বিষয়, দেখভালের অভাবে লঞ্চঘাটের অস্থায়ী লাইব্রেরির বই নষ্ট হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মানুষ যে বইয়ের সংস্পর্শে আসছে, এতেই আমরা খুশি।’
পাবলো ও অ্যাবেলের সঙ্গে আরাফাতের এখনো নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ৩০ দেশ ঘুরে এখন নিজ দেশে ফিরেছেন দুই তরুণ। তাঁদের ‘বিশ্ব ভ্রমণ’ অভিযান আপাতত স্থগিত আছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে হয়তো আবারও কোনো একদিন হাজির হয়ে যাবেন বাংলাদেশে।