স্নাতক থিসিস বুয়েটের জারীনকে এনে দিয়েছে বড় পুরস্কার

জারীন তাসনীম শরীফ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

যে বয়স থেকে স্থপতি হওয়ার ইচ্ছা, সে বয়সে স্থাপত্য সম্পর্কে ধারণাই থাকার কথা নয়। তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট কিংবা সংসদ ভবন দেখতে দেখতে মনে মনে স্বপ্নটা বুনতে শুরু করেছিলেন জারীন তাসনীম শরীফ।

স্বপ্ন পূরণও হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে পড়েছেন জারীন। তবে পরের অর্জনটা স্বপ্নের চেয়েও বেশি। স্থাপত্যের শেষ বর্ষে করা থিসিস প্রকল্প জারীনকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ‘গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস’ বিজয়ীদের তালিকায় উঠেছে তাঁর নাম।

আরও পড়ুন

গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডস আয়ারল্যান্ডভিত্তিক অলাভজনক একটি সংগঠন। পুরস্কারটির পৃষ্ঠপোষক আয়ারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট মাইকেল ডি হিগিনস। বিশ্বের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ও সৃজনশীল কাজগুলোকে স্বীকৃতি দেয় এ পুরস্কার।

২৫টি ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীরা তাঁদের কাজ জমা দেওয়ার সুযোগ পান। প্রতিটি ক্যাটাগরি থেকে একজনকে ‘গ্লোবাল উইনার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বছর ‘আর্কিটেকচার অ্যান্ড ডিজাইন’ ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল উইনার হয়েছেন বাংলাদেশের জারীন। প্রতিযোগিতাটি যে সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক, সেটি অন্য বিজয়ীদের নামের তালিকার দিকে তাকালে বোঝা যায়। নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ড, কানাডার টরন্টো মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের নানা দেশের তরুণেরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জয়ী হয়েছেন। সারা পৃথিবী থেকে ২ হাজার ৮১২টি থিসিস প্রকল্প জমা পড়েছিল এ বছর।

জারীন ঢাকার মেয়ে। তাই স্নাতকের থিসিসে রাজধানীরই কোনো একটি সমস্যার সমাধান খুঁজছিলেন তিনি। ঢাকার মাতুয়াইল এলাকাটিকে কীভাবে বর্জ্যের ‘অত্যাচার’ থেকে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে কাজ করেছেন তিনি।

ঢাকার বর্জ্য অপসারণের জন্য মাতুয়াইলে ল্যান্ডফিল স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। ওই সময় থেকে সেখানে গড়ে উঠছে বর্জ্যের পাহাড়। ময়লা–আবর্জনা সেখানে ফেলে শহরের মানুষ যেন ভুলেই গেছে মাতুয়াইলের কথা। এদিকে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। মাতুয়াইল এলাকাটি হয়ে উঠছে বসবাসের অনুপযোগী। এলাকার ধনীরা অন্যত্র চলে গেছেন। এ বর্জ্য ঘিরে গড়ে উঠেছে ভিন্ন এক সম্প্রদায়।

থিসিসের কাজেই জারীনকে একাধিকবার এ ‘আবর্জনার পাহাড়ে’ যেতে হয়েছে। আশপাশে ঘুরে তিনি নোট নিয়েছেন। আবর্জনা পুনর্ব্যবহার করে সেখানকার মানুষ কীভাবে জীবনধারণ করে, কাছ থেকে দেখেছেন। এসবের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে তাঁর থিসিস প্রকল্পের ধারণা। জারীন বলেন, ‘একদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ল্যান্ডফিলের ভয়াবহ দিক, যা পরিবেশ ও মানুষের জীবনকে দূষিত করছে। আবার অন্য দিকে এ বর্জ্য ঘিরেই গড়ে উঠেছে একটা অনানুষ্ঠানিক রিসাইকেল শিল্প, যা অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এসব থেকেই আমি ভেবেছি, আবর্জনা পরিশোধনের সঙ্গে রিসাইকেল শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করে কীভাবে একটা সামঞ্জস্য তৈরি করা যায়।’

বর্জ্য পরিশোধন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্যগুলো আলাদা করা এবং জমি পুনরুদ্ধার করে কৃষিচর্চাকে আবার উদ্বুদ্ধ করা—সবই আছে জারীনের ভাবনায়। প্রকল্পটির বিস্তৃতি ব্যাপক বলেই হয়তো এটি তাঁকে পুরস্কার জিতে নিতে সাহায্য করেছে। জারীন বলেন, ‘থিসিসে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি, কীভাবে একটি সক্রিয় ল্যান্ডফিলকে শিল্প হিসেবে রূপান্তর করা যায়। এর মাধ্যমে মাতুয়াইলের কৃষি ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ধন্যবাদ দিতে চাই আমার সুপারভাইজার, আমার তিন শিক্ষক ড. নাসরিন হোসেন, প্যাট্রিক ডি রোজারিও এবং ড. অপূর্ব কুমার পোদ্দারকে।’

গ্লোবাল আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডসের (ইউএ) নিয়ম অনুযায়ী, বিজয়ীরা স্বর্ণপদক ও সনদ পান। তাঁদের থিসিস ‘দ্য আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লাইব্রেরি’তে প্রকাশিত হবে। পাশাপাশি একটি বৈশ্বিক সম্মেলনেও অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন তাঁরা। এ বছর ৬ থেকে ৯ নভেম্বর আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরে সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ইউএ কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে সম্মেলনে অংশ নেবেন জারীন তাসনীম শরীফ। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা উদ্ভাবনপ্রিয় তরুণদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। দারুণ এ অভিজ্ঞতার জন্য তরুণ এই স্থপতি এখন মুখিয়ে আছেন।