১৭ বছর আগে ঢাকার রাস্তায় স্কেটিং করে ভাইরাল মিনান এখন কী করছেন
মিনান আরার স্বপ্ন অজেয়কে জয়ের। ঝুঁকি নিতে মিনানের ক্লান্তি নেই। কয়েক কিলোমিটার দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠছেন প্রায় চলন্ত লঞ্চে, ছবি তুলছেন ভয়ংকর প্রাণী গলায় পেঁচিয়ে, যৎসামান্য টর্চের আলোয় ভরসা করে মধ্যশীতের রাতে বাস থেকে নেমে পড়ছেন নদীঘাটে একা।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর পায়ের তলায় থাকা স্কেটিংয়ের গতি। স্কেট পায়ে সাঁই সাঁই করে বাতাস কেটে এগিয়ে যান মিনান, যান্ত্রিক রাজধানীর পথে সব প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে। এই গতিই তাঁকে স্বপ্ন দেখায়, বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করবেন স্কেটিংয়ে। ২০০০ সালে রাজধানীর শান্তিনগরে মিনান শুরু করেছিলেন স্কেটিং।
‘ম্যাগনোলিয়া স্কেটিং ক্লাব’ এবং ‘জামির র্যাপিড স্কেটিং ক্লাব’ নামে রাজধানীতে দুটি ক্লাব পরিচালনা করেন মিনান। ম্যাগনোলিয়া বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনে নিবন্ধিত।
২০০৭ সালে আইসিসি বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেটে জিতেছিল বাংলাদেশ। টাইগারদের সেই জয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সারা দেশেই। জয় উদ্যাপন করতে সবুজ শাড়ি পরা মিনান আরা হাতে পতাকা নিয়ে স্কেটিং করেছিলেন ঢাকার রাস্তায়। ছবিটি সে বছর ২৫ মার্চ প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ঢাকায় থাকি’তে ছাপা হয়েছিল। প্রায় ১৭ বছর আগে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
মিনান আরার আরও পরিচয় দিতে চাইলে যেতে হবে কয়েক বছর পেছনে। ২০০৭ সালে আইসিসি বিশ্বকাপে একটি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৫ উইকেটে জিতেছিল বাংলাদেশ। সেদিন ঢাকা শহরে আনন্দের বন্যার মধ্যে টিএসসির সামনে আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সবুজ শাড়ি পরা, হাতে পতাকা বহন করা এক নারী। তিনি আসছিলেন স্কেটিং করে। ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোতে। প্রায় ১৭ বছর আগের সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেটি দিয়ে অনেকে করেছিলেন নিজের প্রোফাইল ছবি। মিনান তখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতেন না। তিনি জানতেন না, তাঁর ছবি মানুষের কাছে ছড়িয়ে গিয়েছে। জেনেছেন বহু বছর পরে।
ছোটবেলা থেকে মিনানের ইচ্ছা ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার। তাঁর এই শখে আশকারা দিয়েছিল মাসুদ রানা আর তিন গোয়েন্দার বইগুলো। বুঝতে শেখার বয়স থেকে তাই নিজেকে এমনভাবে তিনি তৈরি করতে শুরু করেন, যেখানে ভয়ের স্থান নেই।
একবার মিনান আরা আর তাঁর মা রাইসিন গাজী যাচ্ছিলেন খুলনায়। তখন আরিচা ঘাট দিয়ে যেতে হতো। মা ফেরিতে উঠতে পারলেও মিনান পারেননি। একটুও দেরি না করে মিনান ফেরিঘাট থেকে দৌড় দিলেন লঞ্চঘাটের দিকে। আশপাশের মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, একটি মেয়ে ঝড়ের গতিতে দৌড়াচ্ছে। মিনান বলেন, ওটা অলিম্পিক হলে বোধ হয় জিতেই যেতাম। প্রায় চলতি লঞ্চে লাফিয়ে উঠে মাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘দেখবে একই সঙ্গে ওপারে গিয়ে নামব। ভয় পেয়ো না।’
জীবনের এসব টুকরা স্মৃতি আনন্দের। তবে মিনানের সবচেয়ে বেশি আনন্দ বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারার মুহূর্ত। শ্রীলঙ্কা কি আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি, যেখানেই যান না কেন, তাঁর সঙ্গে থাকে বাংলাদেশের পতাকা আর স্কেটিং। স্কাউট হয়ে অনেক দেশে গিয়েছেন। পায়ে স্কেটিং লাগিয়ে ঘুরেছেন পাকিস্তানে। অবাক হয়ে অনেকে বলেছে, তোমাদের দেশে মেয়েরা স্কেটিং করে? মিনানের জবাব ছিল, ‘তোমরা এখনো যা ভাবতে পারো না, তেমন অনেক কিছুই আমরা করে দেখিয়েছি।’ নানা রকমের সচেতনতামূলক প্রচারণার কাজে মিনান ঘুরেছেন দেশের ৪৬টি জেলায়।
মিনান বললেন, ‘আমার জানামতে, বাংলাদেশে সম্ভবত আমিই একমাত্র নারী স্কেটিং কোচ। তবে আশা করছি, আগামী দিনে আরও অনেক মেয়ে তৈরি হবে।’
মিনানের মা রাইসিন গাজী বলেন, ‘মেয়ের ডানপিটে সাহসী কাজগুলো আমাকে মানসিক শক্তি দেয়। আমি নিজেও খুব উপভোগ করি।’
মিনান বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের (বিআরএসএফ) যুগ্ম সম্পাদক। বিআরএসএফের আরেক যুগ্ম সম্পাদক আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে জানান, ‘মিনান আরা খুব ধৈর্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন। একাধিকবার জাতীয় স্কেটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে তাঁর ম্যাগনোলিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। মেয়েদের মধ্যে তিনি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।’
শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ যা–ই পরুন না কেন মিনান আরা মাথায় স্কার্ফ দেন। পোশাক কখনো স্কেটিংয়ে জন্য তাঁর কাছে বাধা বলে মনে হয়নি।
মিনান রাজধানী খিলগাঁও পার্ক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। স্বামী আর মাকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে। কোনো ব্যস্ততাই তাকে বিচ্যুত করতে পারেনি পায়ের তলার গতি থেকে। বললেন, ‘স্কেটিং না করলে মনে হয় কী যেন করা হয়নি। আমার প্রতিটি কোর্সে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী আসে। এ দেশের মেয়েরা পারে না কথাটি আমি মানতে নারাজ।’