তুমি মায়ের মতোই ভালো
আমরা যারা মফস্সল শহর থেকে এসেছিলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের বুকে টেনে নিয়েছিল। প্রাপ্তির প্রচুর আনন্দে অতি দ্রুত মিলিয়ে গিয়েছিল ছেড়ে আসার অনুভূতি। সেখানকার প্রকৃতি আর মানুষেরা যেন অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। এক মায়ের কোল ছেড়ে অন্য মায়ের কোলে চলে এসেছিলাম আমরা। সে অনেক দিন আগের কথা, বছর বিশেক হবে। তখন আমাদের ক্যাম্পাসে এত মানুষ ছিল না, ছিল না দালানের নামে যত্রতত্র কংক্রিটের জঞ্জাল। তখন চারপাশে সবুজ ছিল অবারিত। বনের বুক চিরে চলা ঘাসে ছাওয়া পথে আনমনে গেয়ে ওঠা মানব–মানবী আর পাখপাখালি ছিল। লেকের পানিতে শান্ত, নিবিড়, নৈসর্গিক নীরবতা ছিল। দুই–তিন মাসের মধ্যে ক্যাম্পাসের প্রায় সব লোক মুখচেনা হয়ে গিয়েছিল আমাদের। শিক্ষক থেকে শুরু করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চেহারাও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ঘুরতে–ফিরতে, দেখা হতে হতে। হয়তো কোনো দিন কথা হয়নি, তবু আমরা পরস্পরকে চিনতাম।
খালা ক্যাশে বসে বসে পান চিবুতেন। যখনই দেখতেন, আমি অর্ধেক খাবার প্লেটে রেখে হাত ধুতে যাচ্ছি, ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে চলে আসতেন। বলতেন, ‘মামা, উইঠেন না। আজকের তরকারি ভালো হয় নাই। আপনার এগুলা খাওয়া লাগব না। আপনে একটু বসেন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম জমা দিতে এসে মাথার ওপর খুব কাছ দিয়ে এক ঝাঁক আশ্চর্য টিয়া পাখি উড়ে যেতে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তখনই ঠিক করেছিলাম, এখানে পড়ব। আগে জানতাম না টিয়া মানুষের এত কাছে আসে। এত দিন অনেক উঁচু গাছে, অনেক দূরে টিয়া পাখি দেখেছি। চিরকাল সে আমার দূরের পাখি হয়েই ছিল। তাই খুব অবাক হয়েছিলাম। তারপর তো জানালার দুহাত দূরেই আসত টিয়া, শালিক, ঘুঘু, শ্যামা, বুলবুলিসহ নাম না জানা কত পাখি! পড়ার টেবিল থেকেই ওদের সঙ্গে খুনসুটি করা যেত দুপুর গড়িয়ে গেলে।
শান্ত প্রকৃতি আর খুব আপন করে নেওয়া মানুষ এখনো সম্ভবত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বৈশিষ্ট্য। সে কারণে এখান থেকে বের হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা এর মায়া ছাড়তে পারেন না। ঘুরেফিরে আসেন নানা সময়ে। অবশ্য শিক্ষার্থী বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি এই ঘোরাফেরা একটা বিড়ম্বনা হয়েও দাঁড়িয়েছে। আর ছুটির দিনে মানুষ, গাড়িঘোড়ার ভিড় প্রাণ-প্রকৃতি ও শিক্ষার্থীদের বিরক্তির কারণও হয়ে ওঠে। কিন্তু বছর বিশেক আগে আমরা কোনো প্রাক্তন বড় ভাই বা আপুকে ক্যাম্পাসে দেখলে খুব খুশি হতাম। খুশি হতাম কারও বাড়ি থেকে মা–বাবা বা কোনো আত্মীয় এলেও। তাঁদের লেজে লেজে দল বেঁধে ঘুরতাম সারা দিন। কেউ এলে উৎসবের আবহ তৈরি হতো।
ছোট থেকেই ছিলাম বেশ রোগা ধরনের। ডাক্তারি ভাষায় বললে ‘আন্ডারওয়েট’। বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে এসে যে ব্যাপারে সমস্যায় পড়লাম, তা হলো খাওয়াদাওয়া। এই একটা ব্যাপারেই খুব খুঁতখুঁতে ছিলাম। যে কারণে বাড়িতেও প্রতিবেলায় আমার জন্য আলাদা কিছু আয়োজন রাখতে হতো। যাহোক, ক্যাম্পাসে সবারই নিয়মিত খাওয়ার জায়গা ছিল প্রধানত তিনটা। হলের ভেতরে ডাইনিং, ক্যানটিন আর হলের বাইরে টিনের টং ধরনের দোকানগুলো। এর বাইরে ক্যাফেটেরিয়াসহ আরও কিছু জায়গা ছিল খাওয়ার। সেসব ছিল হল থেকে দূরে। মেয়েরা অবশ্য রুমে টুকটাক রান্নাবান্না করে খেত। মাওলানা ভাসানী হলের ছেলেদের কাছে বটতলার দোকানগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল। প্রতিটি হলের সামনে এমন দোকানের সারি থাকলেও বটতলার জায়গাটা আকার–আয়তনে একটু বড় ছিল। সে কারণে বটতলায় অন্যান্য হল থেকে ছেলেমেয়েরা খেতে আসত।
বটতলায় তখন সাত–আটটা দোকান ছিল। সব দোকানে ছাত্রদের বাকির খাতা থাকত। খাওয়ার পর বিলের অঙ্কটা নিজেই লিখে রেখে আসতে হতো। মাসের শুরুতে বেশ কিছু টাকা আগাম দিয়েও রাখতাম আমরা। আমি খেতাম বটতলায়। বটতলার দোকানিরাও আমাকে নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তেন। তরকারি ভালো না হলে খেতে পারতাম না। ভালো লাগছে না বললে তরকারি পাল্টে দিতেন, সব সময় বাড়তি টাকাও রাখতেন না। বাসি তরকারি তো দূরে থাক, শীতের দিনে দুপুরে রান্না করা তরকারি রাতের বেলায় দিতেন না আমাকে। তাঁরা জানতেন, আমি ঠিক ধরে ফেলব।
এমনিতে বাড়তি তরকারি হোটেলওয়ালারা ফেলে দেন না। ফ্রিজে রেখে পরের বেলায় গরম করে খাওয়ান। আমার বেলায় সেটা করা যেত না, তাঁরা চেষ্টাও করতেন না। মোটকথা, বাড়ির মতোই আবদার করা যেত দোকানিদের কাছে। এত কিছুর পরও খাওয়াদাওয়াটা নিয়মিত ছিল না আমার। কোনো কোনো বেলায় খেতাম না। চা-বিস্কুটেই ক্ষুধা মরে যেত। ইচ্ছা করত না খেতে। কোনো কোনো বেলায় আধপ্লেট ভাত খেতাম। ফলে স্বাস্থ্যের উন্নতি আর হচ্ছিলই না।
এক দোকানে কয়েক মাসের বেশি খেতে পারতাম না। খাবার খুব একঘেয়ে লাগতে আরম্ভ করলে লেনদেন চুকিয়ে চলে আসতাম। এতে কিছুটা মান-অভিমানের পরিস্থিতিও তৈরি হতো। কেননা সম্পর্কগুলোই ছিল ও রকম। দোকান পাল্টাতে পাল্টাতে একবার খালার দোকানে খেতে শুরু করলাম। খালার নাম আমরা কেউই জানতাম না। মামাদের দোকানের ভিড়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী দোকানদার, তখন পর্যন্ত। আমরা খালা বলে ডাকতাম। পুরুষ দোকানদারদের মামা আর নারী দোকানদারদের খালা। আরেক খালার দোকান ছিল ট্রান্সপোর্ট এলাকায়, সেটা ছিল চায়ের দোকান। সেই খালার ছেলে পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছিলেন।
যাহোক, খালার ভাতের দোকানে এসেও খাওয়ার পরিমাণ বাড়ল না। কিন্তু খালা ব্যাপারটা খেয়াল করতেন। আগের দোকানিরা খেয়াল রাখলেও খালার ব্যাপারটা আলাদা করা যেত। সাধ্যমতো সদ্য রান্না গরম ও ভালো তরকারি দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। আমি যে খেতে পারি না, এটা তিনি বিশেষভাবে খেয়াল করেছিলেন। দোকানের কর্মচারীদের বলে দিয়েছিলেন আমি এলে যেন বিশেষ নজর রাখা হয়। তাঁরাও খেয়াল করতেন। খালা ক্যাশে বসে বসে পান চিবুতেন। যখনই দেখতেন, আমি অর্ধেক খাবার প্লেটে রেখে হাত ধুতে যাচ্ছি, ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে চলে আসতেন। বলতেন, ‘মামা, উইঠেন না। আজকের তরকারি ভালো হয় নাই। আপনার এগুলা খাওয়া লাগব না। আপনে একটু বসেন।’ বলে ক্যাশবাক্সের পাশে রাখা খাবারের বাটি নিয়ে ফিরে আসতেন। খাবারগুলো খালা নিজে খাওয়ার জন্য বাসা থেকে রান্না করে আনতেন। সেই খাবার থেকে আমার প্লেটে তরকারি তুলে দিতেন পরম যত্নে। এটা এক দিনের ব্যাপার ছিল না, প্রায়ই এই ঘটনা ঘটত। এর জন্য কোনো দিন আলাদা টাকা নিতেন না তিনি।
ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার পর যা হয়, আর কখনো দেখা হয়নি খালার সঙ্গে। কয়েক দিন আগে শুনলাম, তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুসংবাদে মনটা বিষণ্ন হয়ে এল খুব। এসব মানুষ কত নিভৃতে আমাদের বেড়ে ওঠায় অবদান রাখেন। কোনো প্রাপ্তির আশা না করে কেবল স্নেহ-ভালোবাসায় ভাসিয়ে দিয়ে যান! আর আমরা কত সহজে তাঁদের ভুলে যাই!