ব্র্যান্ড না চেনা ছেলেটাই ব্র্যান্ড হয়ে উঠুক
প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩১ সনেও দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, ডিজিটাল মঞ্চ, ব্যবসা, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণদের নিয়ে আজ ছাপা হয়েছে দুই পাতার এই বিশেষ আয়োজন। যেখানে অভিনেতা খায়রুল বাসারকে নিয়ে লিখেছেন নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান
নেটওয়ার্কের বাইরে সিনেমার জন্য ‘মুন্না’ নামের চরিত্রকে খুঁজছিলাম। আমার সহকারীরা তিনটি অপশন দিল। ৩ নম্বরে ছিল খায়রুল বাসার। কেন যেন তাকেই আমার বেশি ঠিকঠাক লাগল। সহকারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, খায়রুল কেন ৩ নম্বরে?
ভাইয়া, উনি ভদ্র কিসিমের। আমাদের চরিত্র তো একটু দুষ্টু। আর ওনাকে মানুষ তেমন একটা চেনে না!
আমি বললাম, ভদ্র দেখেই দুষ্টু ক্যারেক্টারে ভালো লাগবে। চেনে না তো, চিনবে। ডাকো অফিসে।
সেই অচেনা–অপরিচিত ছেলেকে ঘিরে এখন যখন মানুষ ভিড় করে, সেলফি তোলে—আমার ভীষণ ভালো লাগে। হয়তো চোখের সামনে বড় হতে দেখছি তাই, নয়তো খায়রুল বেশি কাছের বলে।
খায়রুল (বাসারকে আমি এই নামেই ডাকি) একবার অ্যাকসিডেন্ট করল। হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়ে তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। সেদিন আলাপে খায়রুল সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জেনেছি। খায়রুলকে আমার অল্পতেই তুষ্ট মানুষ বলে মনে হয়। তার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছি, ছোটবেলা থেকেই তার চাহিদা কম। এই বড় ভাই ছিল খায়রুল বাসারের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত বড় ভাইয়ের কাছেই সে পড়েছে।
একটা লম্বা সময় আমার অফিস উত্তরায় ছিল। একদিন খায়রুল অফিসে এল। কথায় কথায় বলল, ‘ভাই, আপনার অফিসটা খুব সুন্দর জায়গায়। এ রকম জায়গায় আমার বাসা হলে ভালো হতো!’ পরের দিনই দেখি বিল্ডিংয়ে ‘টু-লেট’ টানানো। খায়রুল এলে বললাম, আমার অফিসের ওপরের ফ্লোর ফাঁকা। ভাড়া নিতে পারো। ভালো–মন্দ যা রান্না করবা জানলা দিয়ে দড়ি বেঁধে পাঠিয়ে দিবা!
পরে গিয়ে দেখি, আমি ভুল। আমার নিচের ফ্লোরের জন্য টু-লেট দেওয়া। খায়রুল তো মহা খুশি। সে বলে, ‘ভাই, আমার জন্য খাবার পাঠাতে হবে না, আপনি শুধু আপনার বেস্ট স্ক্রিপ্টগুলো ওপর থেকে নিচে পাঠিয়ে দিয়েন।’
খায়রুলের সঙ্গে আমার কাজের সংখ্যা যত কম, জানাশোনা তত বেশি। কারণ, যোগাযোগ। অপূর্ব ভাইয়ের পর সহকর্মীর খোঁজ রাখতে আমি যে কয়েকজনকে দেখেছি, খায়রুল বাসার তাদের অন্যতম।
অভিনয়ে খায়রুল দিন দিন ভালো করছে। দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে অল্পে সন্তুষ্ট থাকা খায়রুল যেন জীবনে কখনো তার অভিনয় নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়।
খায়রুল বই পড়ে অনেক, গান গায় ভালো। অভিনয়, গান, সিনেমা, বই—এসব নিয়েই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
নেটওয়ার্কের বাইরে-র পাশাপাশি যত্ন এবং সে বসে একা খায়রুলকে নিয়ে নির্মিত আমার প্রিয় কাজ। এ ছাড়া নাটক তোমার পাশে হাঁটতে দিও এবং সাম্প্রতিক কালে কাজলরেখা সিনেমায় স্বল্প উপস্থিতিতেও তার অভিনয় ভালো লেগেছে।
খায়রুলকে নিয়ে বাইরে গেলে দেখি, সে মাস্ক না পরেই হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি মাস্ক পরতে বললে বলে,‘ভাই, আমাকে কেউ চিনে না। সমস্যা নাই।’
খায়রুল মাস্ক পরে চলে না। না মুখে, না জীবনে। ওকে আমার স্বচ্ছ লাগে। দিঘির জলের মতো শান্ত শীতল। বিনয়ী, ভদ্র। অনেকে অতীত ভুলে যায়, কেউ কেউ ভোলে না। আমার মনে হয়েছে, অতীত ভুলে যাবে এমন ছেলে খায়রুল বাসার নয়। আশপাশের স্বার্থপর, শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবা শত শত মানুষের ভিড়ে খায়রুলদের মতো মানুষও দু-একজন থাকুক।
দুধ-কলা-ভাত খায়রুলের সবচেয়ে প্রিয় খাবার। কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ভালো, কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি সুন্দর—কিছুই সে তেমন জানে না। এই ব্র্যান্ড না চেনা সাদামাটা ছেলেটা বাংলা কনটেন্টের ব্র্যান্ড হয়ে উঠুক, এই প্রত্যাশাই করি।
খায়রুলের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।