এআই যদি সবার চাকরি ‘খেয়ে’ নেয়, তাহলে পড়ব কোন বিষয়ে

যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাঁদের জন্য লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক বি এম মইনুল হোসেন

বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীর মনন তৈরি করে, তার চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে
ছবি: অগ্নিলা আহমেদ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে চারদিকে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। এআই–ভিত্তিক নিত্যনতুন উদ্ভাবন সবাইকে চমকে দিচ্ছে। চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে চালকবিহীন গাড়ি, সংবাদ উপস্থাপনা থেকে শুরু করে রোগনির্ণয়—নানা ধরনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বলা হচ্ছে, সামনের পৃথিবী হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পৃথিবী। এমনকি আমাদের বেশ কিছু কাজকর্মও নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলে চলে যাবে। মানুষের বদলে মেশিন সম্পন্ন করবে সেসব কাজ।

এমন পরিস্থিতিতে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে কোন বিষয় নির্বাচন করা উচিত? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক যে ভবিষ্যতের কথা বলা হচ্ছে, শুধু সেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ই কি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে? তাহলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আরও যেসব বিষয় আছে, মানবিক, বাণিজ্য ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখার যে এত এত বিষয় আছে, শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট যত বিষয় পড়ার আছে, সে সবের গুরুত্ব কি কমে যাবে? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাক।

আমরা যে গণিত পড়ি বা গণিত জানি, সাধারণ যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ থেকে শুরু করে শতকরা বা ভগ্নাংশ, সেটি শুধু যে গণিতের শিক্ষার্থীরা জানবে তা নয়। যে কোনো বিষয়ের শিক্ষার্থীর, এমনকি যেকোনো মানুষেরই টুকটাক গাণিতিক জ্ঞান থাকা জরুরি। প্রয়োজনীয় গণিত সাহিত্যের শিক্ষার্থীকেও জানতে হয়, বাণিজ্যের শিক্ষার্থীকেও জানতে হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু আলাদাভাবে গণিত বিষয়টিও আছে। বর্তমান বা ভবিষ্যৎ, কখনোই গণিতের ওপর আমাদের নির্ভরতা কমবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সবাইকে গণিত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। আবার কারও যদি প্রকৃত অর্থেই গণিতের প্রতি আগ্রহ থাকে, তাহলে তার গণিত বিষয়ে ভর্তি হতে কোনো বাধাও নেই।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও বিষয়টাকে একইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাহিত্য, কৃষি কিংবা প্রযুক্তির এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া লাগেনি। তার মানে এই নয় যে সবাইকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভর্তি হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, এ রকম বেশির ভাগ বিষয়ের ক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে কিছু মাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংশ্লিষ্টতা চলে আসবে। সে অনুযায়ী প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সিলেবাসেও পরিবর্তন আসবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির বিষয়ের বাইরেও এখন তথ্যপ্রযুক্তি বা প্রোগ্রামিং–সংশ্লিষ্ট বিষয় পড়ানো হয়।

বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের বা আগ্রহের গুরুত্ব আছে। ভবিষ্যৎ চাকরির বাজারও বিষয় নির্বাচনে ভূমিকা রাখে। তবে সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, সে বিষয়ে পড়তে গেলে কমপক্ষে যতটুকু যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন, তা যেন থাকে। যেমন তোমার যদি গণিত বিষয়ে দক্ষতার ঘাটতি থাকে বা বিষয়টিতে আগ্রহ না পাও, তাহলে শুধু শুধু শখের বশে প্রকৌশল–সংক্রান্ত বিষয়ে না পড়াই ভালো। এ ছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যেখানে খুব বেশি মাত্রায় গণিতের প্রয়োজন হবে না। সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তি বা কম্পিউটারবিজ্ঞান–সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে পড়লে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ক্যারিয়ার গড়তে সুবিধা হয়। এসব বিষয়ে পড়তে গেলে গাণিতিক দক্ষতা থাকা জরুরি।

আরও পড়ুন

এটি ঠিক যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা সংশ্লিষ্ট কাজে বিশ্বব্যাপী প্রচুর লোকবলের চাহিদা আছে। সেসব বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকা যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে জন্য যে ওই বিষয়েই বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও বেশ কিছু দক্ষতা অর্জন সম্ভব। সম্ভাব্য চাকরির বাজার ভালো অথবা চারদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শোনা যাচ্ছে, তাই বলে সেদিকে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং বিভিন্ন দিক বিচার-বিবেচনা করে নিজের জন্য উপযুক্ত বিষয় নির্ধারণ করতে হবে।

তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য একজন শিক্ষার্থী যে সময় ব্যয় করে, পরবর্তী সময়ে তার প্রায় ১০ গুণ সময় ব্যয় করে কর্মক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে সে সময়টুকু যে আরও জিনিস শেখা যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই। শেখার আগ্রহ থাকলে সেটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসরুম থেকে পড়ে শিখতে হবে বা ডিগ্রি অর্জন করে শিখতে হবে, এমনটাও নয়; বরং ক্লাসরুমের বাইরে দক্ষতা অর্জন করার এখন অনেক অনেক মাধ্যম রয়েছে। অর্থাৎ পরবর্তী সময়ে প্রয়োজন হলে নিজের কাজের জন্য যতটুকু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষতা প্রয়োজন হবে, সেটি অর্জনের সুযোগ শেষ হয়ে যাবে না।

ভবিষ্যতের চাকরি নিশ্চিত করাটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনা, পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন, বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যৌক্তিক বিবেচনা, কার্যকর যোগযোগ, নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা, সৃষ্টিশীলতা ইত্যাদি দক্ষতা অর্জনও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীর মনন তৈরি করে, তার চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করতে সহায়তা করে। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ জিনিসগুলোও বিবেচনা করা প্রয়োজন। অথবা বিষয় যেটিই হোক না কেন, এ দিকগুলো অর্জনে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই যুগেও সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন অকৃত্রিম মানবিক মূল্যবোধ অর্জনে।

Email: [email protected]