প্রেম কিংবা ভালোবাসা হচ্ছে এমন এক জিনিস, যা কোনো ধরনের সংজ্ঞা দ্বারা বিধিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। কখন কাকে ভালো লেগে যায়, সে সম্পর্কেও আগে থেকে কেউই সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেন না। প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার অনুভূতির সামনে বয়স, ধর্ম কিংবা পারিবারিক কোনো বিষয় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে না।
তবে আমাদের উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা রক্ষণশীল হওয়ায় প্রেমিকা কিংবা বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সচরাচর ভিন্ন ধর্মের দুজন মানুষের মধ্যকার প্রেমের পরিণতি আমাদের উপমহাদেশে খুব কমক্ষেত্রেই সফলতা পায়। অন্যদিকে সাধারণত অসম প্রেমকাহিনি, বিশেষ করে প্রেমিকের তুলনায় প্রেমিকা যদি বয়সে বড় হন, তাহলে সে ধরনের প্রেমকাহিনিও এই উপমহাদেশে তেমন একটা আলোর মুখ দেখে না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কখনো কোনো মা–বাবা মেনে নিতে পারেন না যে তাঁদের ছেলে এমন কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম কিংবা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোক, যে মেয়ে তাঁদের ছেলের তুলনায় বয়সে বড় কিংবা ধর্মে ভিন্ন।
তবে ইউরোপে বর্তমানে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত, রেনেসাঁ–পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে চার্চের প্রভাব কমে আসতে থাকে। বিশেষ করে গত শতাব্দীর শেষের দিকে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের ফলে ইউরোপের অনেক দেশে এখন তেমন একটা ধর্মীয় প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না বললেই চলে। যদিও ইতালিসহ ইউরোপের কিছু দেশ যেমন পর্তুগাল, পোল্যান্ড, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া—এসব দেশে এখনো চার্চের প্রভাব রয়েছে এবং জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ের তুলনায় দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবেও কিছুটা দুর্বল।
আর প্রেমিকা কিংবা গার্লফ্রেন্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইউরোপে এখন বেশির ভাগ পুরুষই তুলনামূলকভাবে এমন কাউকে নির্বাচন করছেন, যিনি তাঁর তুলনায় বয়সে বড়। এর পেছনে অবশ্য মনস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। যেমন বয়সে বড় প্রেমিকা মানে অবশ্যই বাস্তব অভিজ্ঞতার দিক থেকে তিনি এগিয়ে থাকবেন শুধু নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে নয়, সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেকোনো বিষয়ে।
অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সালজবুর্গের ডিপার্টমেন্ট অব সাইকোলজির এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২২ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে ৫২ শতাংশ মনে করছেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁদের তুলনায় অধিক বয়স্ক প্রেমিকারা তাঁদের জন্য বেশি উপযোগী।
তাঁর দক্ষতা হবে তুলনামূলকভাবে বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণে ইউরোপে বর্তমানে বেশির ভাগ পুরুষই প্রেমিকা কিংবা গার্লফ্রেন্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বয়স্ক নারীদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। সম্প্রতি অস্ট্রিয়ায় অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সালজবুর্গের ডিপার্টমেন্ট অব সাইকোলজির এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২২ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে ৫২ শতাংশ মনে করছেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁদের তুলনায় অধিক বয়স্ক প্রেমিকারা তাঁদের জন্য বেশি উপযোগী। ৪০ শতাংশ যুবক মনে করছেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রেমিকাদের বয়স তাঁদের কাছে তেমন একটা মুখ্য নয় এবং অবশিষ্ট ৮ শতাংশ যুবক এ বিষয়ে কোনো মতামত দেননি।
ডেনমার্কের এক অধিবাসী গুস্তাভ সোরেনসেন। তাঁর বয়স প্রায় ৩০ বছর। প্রায় চার বছর ধরে তিনি মিই শিয়েরলিং নামের এক নারীর সঙ্গে বসবাস করছেন। মিই শিয়েরলিং গুস্তাভ সোরেনসেনের চেয়ে বয়সে পাঁচ বছরের বড়। তারপরও গুস্তাভ ও মিই উভয়ই মনে করছেন, তাঁদের দুজনের মধ্যকার এ প্রণয় সফল। সাক্ষাৎকারে গুস্তাভ জানিয়েছেন, ডেনমার্কের সমাজব্যবস্থা ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক উদার, যদিও আমাদের দেশে পারিবারিক কাঠামো এখন বলতে গেলে অনেকটা দুর্বল। এ কারণে আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে গিয়েছে। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে পরিবারের সন্তানদের ওপর।
গুস্তাভ আরও বলেন, যদিও ডেনমার্কসহ ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশে বিবাহের ওপর মানুষের আকর্ষণ অনেকটা কমে এসেছে, তবুও ছেলেরা বর্তমান সময়ে প্রেমিকা বা গার্লফ্রেন্ড নির্বাচনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে তাঁর তুলনায় অধিক বয়স্ক মেয়েদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। আমার মতো তাঁদের বেশির ভাগের যুক্তি, বয়সে বড় প্রেমিকা মানে তিনি আপনাকে কোনো বিষয়ে গাইড করার ক্ষমতা রাখবেন। যদি আপনার মধ্যে কোনো মানসিক বিষণ্নতা থাকে, তাহলে আপনি সহজে তাঁর সঙ্গে সেটি শেয়ার করতে পারবেন এবং আপনার প্রেমিকাও দক্ষতার সঙ্গে সেটি সমাধানে আপনাকে সহায়তা করবেন। এ ছাড়া যেকোনো বিষয়ে দুজন পারস্পরিক মতামতের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন। কিন্তু প্রেমিকা বয়সে ছোট হলে অনেক ক্ষেত্রে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার আপনাকে একা সামলাতে হবে।
গুস্তাভের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত পোষণ করেছেন নেদারল্যান্ডসের অধিবাসী ইয়োলমের ডি ইয়ং। তিনি বলেন, আপনার প্রেমিকা কিংবা গার্লফ্রেন্ড যদি বয়সে আপনার থেকে বড় হয়, তাহলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে বেশি থাকবে। তাই যেকোনো সন্ধিকালীন মুহূর্তে ভুল–বোঝাবুঝির সম্ভাবনা অনেকটা কমে আসে। ফলে সম্পর্কের গভীরতাও হয় অনেক দৃঢ়।
আমরা ডিউক অব কেমব্রিজ প্রিন্স উইলিয়াম, বর্তমান ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ অনেকের কথা শুনেছি, যাঁরা তাঁদের তুলনায় বয়সে বড় কোনো নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বিষয়টি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও উপমহাদেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় এখনো এই বিষয়টি তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া