আর্টসেলের লিংকনকে যিনি দিয়েছেন ‘প্রেমিকার ভালোবাসা’
কয়েকজন বন্ধু মিলে মিমোষা লিমু হাওলাদার এক বিকেলে বইমেলায় যাবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু একজনের আসতে দেরি হওয়ায় মেলার গেট বন্ধ হয়ে গেল। পরিকল্পনা বদলাতে লিমুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জান্নাত প্রস্তাব দিলেন, ‘চল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, আজ সেখানে আর্টসেলের কনসার্ট।’
তখনো আর্টসেল বা জর্জ লিংকন ডি’কস্তা নামের সঙ্গে মিমোষা লিমু হাওলাদারের পরিচয় হয়নি। যদিও ‘এই বৃষ্টিভেজা রাতে’ আর ‘অনিকেত প্রান্তর’ গান দুটি তাঁর বেশ পছন্দের। কিন্তু গানগুলো কার গাওয়া, তাঁর জানা ছিল না। জাহাঙ্গীরনগরের সেই কনসার্টে গিয়েই প্রথম আর্টসেল সম্পর্কে জানলেন লিমু। কনসার্ট শেষ হতে বেশ রাত হয়ে গেল, তাঁদের আর ঢাকায় ফেরা হলো না। আর্টসেলের ম্যানেজার বাঁধন আবার জান্নাতের বন্ধু। সেই সূত্রে রাতভর আর্টসেলের সদস্যদের সঙ্গে চলল আড্ডা। ফোন নম্বরও দেওয়া-নেওয়া হলো।
প্রেম না বিয়ের প্রস্তাব
মাঝেমধ্যে লিমুকে ফোন দিতে লাগলেন লিংকন। কথা তেমন বিশেষ কিছু হতো না, ‘ঠিকমতো খেয়েছি কি না, খাবারদাবার নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, পড়াশোনা ঠিকমতো করছি কি না, ইত্যাদি।’ তারকা লিংকনের সেসব কথায় ইডেন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী লিমুর বিশেষ অনুভূতি কাজ করত না। তারপর একদিন লিংকন দেখা করতে চাইলেন। দেখা হওয়ার পর সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব! লিংকন বলেন, ‘আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, এখন আর প্রেম করার সময় নেই। তোমার কী মত?’
এমনটা যে ঘটতে পারে, ভাবতেই পারেননি লিমু। আর লিংকন চাইলেও শুরুতে লিমু আগ্রহীও ছিলেন না। অনাগ্রহের অনেক কারণও অবশ্য ছিল। একটি কারণ বয়স। লিমুর বয়স তখন ২৩ আর লিংকনের ৩৮ বছর। ১৫ বছরের ফারাক। আরেকটি কারণ ছিল লিংকনের ওজন। তখন তাঁর ওজন ১২৪ কেজি। এই ওজনের একজন মানুষকে মন থেকে স্বামী হিসেবে চায় কোন তরুণী! তাই সরাসরি ‘না’ বলে বাসায় ফিরে এলেন লিমু।
হাল না ছাড়া
‘না’ শোনার পর ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার জন্য আরও আকুল হয়ে ওঠেন লিংকন। ফোনে তো আগে থেকেই খোঁজ নিতেন, এবার হোস্টেলের নিচে এসেও দাঁড়িয়ে থাকতে লাগলেন। লিমু বলেন, ‘প্রেম বা বিয়ে কোনোটাতেই আগ্রহ নেই জানানোর পরও চেষ্টা করে গেছে লিংকন। যেভাবে ও আমার খেয়াল রাখত, আমার বাবা ছাড়া এমনটা আর কেউ কখনো করেনি।’
এসবের মধ্যেই লিংকন নিজের কষ্টের গল্পগুলো লিমুর কাছে বলতে থাকলেন। ‘মোটা’ বলে কেউ তাঁকে পছন্দ করে না। লিংকনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার আগে লিমু নিজেও বান্ধবীদের সঙ্গে হাসতে হাসতে বলতেন, ‘একজন মানুষ এত মোটা হয় কী করে! কিন্তু এ কথা সেই মানুষটিকে মানসিকভাবে কতটা ভেঙে দিতে পারে, লিংকনের সঙ্গে পরিচয়ের আগে বুঝতাম না। এভাবেই তাঁর প্রতি আমার মায়া জন্মাতে শুরু করে।’
বিধ্বস্ত রকস্টার
লিমুর সঙ্গে পরিচয়ের আগে লিংকনের জীবন ছিল বেশ অগোছালো। সেসব নিয়ে তিনি বেশ অকপট, ‘বাবা অনেক আর্থিক কষ্ট করেছেন। শেষ বয়সে যখন সচ্ছল হলেন, তখন তিনি খেতে পারেন না। শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। বাবার মৃত্যুর দিন তাঁর শরীরে হাত রেখে তাই প্রতিজ্ঞা করলাম, নিজের জীবনটাকে উপভোগ করব।’
একদিকে বাবার মৃত্যু, অন্যদিকে বডিশেমিং—দুই মিলে লিংকন বেশ বেহিসাবি জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। যাঁরা মঞ্চে জর্জ লিংকন ডি’কস্তার গান শুনে আবেগে আপ্লুত হন, এই লিংকন যেন তার চেয়ে একেবারেই আলাদা। লিংকন বলেন, ‘মোটা বলে মানুষ যে আমায় কত আঘাত দিয়েছেন। এটা আসলে যার সঙ্গে না ঘটে, সে বুঝবে না। এসব কষ্ট ভুলে থাকতেও অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করতাম।’
লিংকনের একান্ত ব্যক্তিগত কষ্টগুলোই একসময় লিমুকে ছুঁয়ে যায়। ওজন বেশি বলে যাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন, তাঁকেই তিনি ভালোবাসতে শুরু করলেন। মানুষটির ভেতরে সৎ ও যত্নশীল একজন মানুষ খুঁজে পেলেন লিমু। ভালোবাসতে শুরু করলেন তাঁকে। লিংকনকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবেন—এই মনের জোরেই তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন লিমু।
অতঃপর...
বাড়িতে লিংকনের কথা জানালেন লিমু। ঘোর আপত্তি করলেন মা–বাবা। তাঁরা জানান, ‘কোনো দিক দিয়েই এই ছেলে তোমার যোগ্য না।’ লিংকনের ওজন, বয়সের বাইরেও লিমুর মা–বাবার ধারণা ছিল, মিডিয়ার লোকজন কখনো সংসারী হতে পারে না।
কোনোভাবেই পরিবারকে যখন রাজি করাতে পারলেন না, তখন লিমু সিদ্ধান্ত নিলেন গোপনে বিয়ে করবেন। দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল। বিয়ে করে লিমুকে তাঁর রাজাবাজারের বাসায় নিয়ে আসেন লিংকন। ছেলের বউকে সাদরে গ্রহণ করেন লিংকনের মা। পরিবারের ভয়ে বিয়ের দিন ফোন বন্ধ রেখেছিলেন লিমু। ফোনে না পেয়ে হোস্টেলে যোগাযোগ করেন মা–বাবা। তাঁরা জানতে পারেন, সেখানেও মেয়ে নেই। তাঁদের আর বুঝতে বাকি রইল না। লিমু বলেন, ‘বাবা আমার নম্বরে একটি এসএমএস পাঠালেন, ‘“তুমি কি বিয়েটা করে ফেলেছ?” বাবাকে সত্যিটাই জানিয়ে দিলাম।’
বেশ কিছুদিন পর কয়েকজন বন্ধু ও স্বজনের সহযোগিতায় মা–বাবার সঙ্গে লিমু-লিংকনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আর এখন তো শ্বশুরবাড়িতে লিংকনই সেরা জামাই। নিজের যোগ্যতা দিয়েই সেটি অর্জন করেছেন তিনি। মা ছাড়াও লিংকন-লিমুর পরিবারে আছে তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে লিও।
জনপ্রিয় তারকা হওয়ার পরও শুধু অতিরিক্ত ওজনের কারণে অনেকেই লিংকনের বন্ধু হতে চাননি, সেই জীবন বদলে দিয়েছেন লিমু। রাজাবাজারের বাসায় যখন এই দম্পতির সঙ্গে কথা বলি, লিংকন নিজেই জানান, এখন তাঁর জীবনে শৃঙ্খলা ফিরেছে। তিনি এখন পুরোপুরি সংসারী একজন মানুষ। লিমু যোগ করলেন, ‘লিংকনকে যদি ফিরিয়ে দিতাম, তবে জীবনের সেরা মানুষটিকে আমি হারাতাম। ওর ওজন, আমাদের বয়সের পার্থক্য, এসব নিয়ে এখনো মানুষের মাথাব্যথা আছে; কিন্তু আমাদের ভালো থাকতে এসব কোনো বাধা না।’