আমার মা একটু অন্য রকম

আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার, মা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে আমরা মাকে নিয়ে লেখা আহ্বান করেছিলাম পাঠকের কাছে। পাঠক লিখেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার পেছনে মায়ের অনুপ্রেরণার গল্প।

মায়ের সঙ্গে ফারজানা হালিম
ছবি: সংগৃহীত

খুব ছোটবেলায় মাকে নিয়ে একবার পরীক্ষায় রচনা লিখেছিলাম। স্কুল থেকে বেরিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আমার সেকি কান্না!

কেন? কারণ, ভুল করে পুরো রচনাই বর্তমানের পরিবর্তে অতীতকালে লিখে ফেলেছি। অর্থাৎ ‘মা ছিল’, ‘করত’, ‘বলত’...এমন। ভুলটা ধরতে পেরেছি একবারে শেষে গিয়ে। বাধ্য হয়েই মেলানোর জন্য শেষে লিখতে হয়েছে, ‘মা এখন আর নেই।’ অপরাধবোধে আমার কোমল হৃদয় তখন কাতর। অথচ আম্মু বলছিল, ‘বোকা মেয়ে, তুমি তো ঠিক কাজই করেছ!’ মা আমার এই ‘বুদ্ধিমত্তা’র গল্প সবাইকে গর্ব করে শোনাত। তখন থেকেই বুঝে গেছি, আমার মা একটু অন্য রকম।

আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারটা আম্মুর বুদ্ধিমত্তাতেই টিকে গিয়েছিল। আব্বুর সীমিত আয়ের চাকরি। কিন্তু আম্মু কেমন করে যেন বেশ সচ্ছলভাবে সংসার পরিচালনা করত। আয়-ব্যয়-সঞ্চয়ের সামঞ্জস্য করে কীভাবে গুছিয়ে চলতে হয়, তার একটা শৈল্পিক রূপ আম্মু দিয়ে ফেলেছিল।

প্যারেন্টিংয়ের সচেতনতা তখন না থাকলেও শাসন আর আদরের মিশেলে আম্মু আমাদের একটু একটু করে ডানা মেলতে দিয়েছে। স্বপ্ন আঁকতে দিয়েছে নিজের মতো করে। জীবনপথে যখনই যে কঠিন দ্বিধার মুখোমুখি হয়েছি, কখনো পারিবারিক চাপ অনুভব করিনি। যেটা অনুভব করেছি, তা হলো ভালোবাসার টান।

আমাদের দুই বোনের মনে কখনো কোনো হীনম্মন্যতার জন্ম আম্মু হতে দেননি। এখন বুঝি, এভাবে আমাদের তৈরি করার জন্য কত ঝড়-ঝাপটাই না আম্মুকে একা সামলাতে হয়েছে।

লোডশেডিং হলে আমার মা গান গাইত। চমৎকার সুর আম্মুর কণ্ঠে। আম্মুর সঙ্গে গাইতে গাইতে আমাদের গলায়ও সুর চলে এল। আমাদের পাল্লায় পড়ে আব্বুও মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে সুর মেলাত। আম্মু আমাদের সেই গানের চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য অনেক দিন চেষ্টা করেছিল। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ভিত্তিটা তৈরি করে দিতে আম্মু যে নিরলস শ্রম দিয়ে গেল, তার কতটুকুই-বা পূরণ করতে পারলাম!

তবে সফলতার সংজ্ঞা যদি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দিতে হয়, সেখানেও আম্মুকে সফল বললে খুব একটা ভুল হবে না। এত প্রতিকূলতার মধ্যে দুই মেয়েকে দেশসেরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো থেকে শুরু করে ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি, সবকিছুই হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সফলতা মানে আরও গভীর কিছু। বোধে, জ্ঞানে, অনুভূতিতে যার শ্রেষ্ঠত্ব মাপা যায়। সাহস, আত্মবিশ্বাস আর সংবেদনশীল মনের সমন্বয়ে গড়া ব্যক্তিত্ব আমার মা যেদিন তৈরি করে দিতে পেরেছে, সেদিন থেকেই সে সফল মানুষ, সফল মা হওয়ার মুকুট মাথায় দিয়ে ফেলেছে।

আমাদের ছোট্ট সুন্দর পরিবারের চার সদস্য এখন চার জায়গার বাসিন্দা। তুলনামূলকভাবে আমি আম্মুর সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি আছি। আমার বড় বোন প্রবাসে, আর আব্বু পৃথিবী থেকে দূরে, অন্য কোথাও। তবু অদৃশ্য মায়ার এক বাঁধনে এখনো বাঁধা পড়ে আছে আমাদের পরিবার। একমাত্র আম্মুর জন্যই সেটা সম্ভব হয়েছে।

আম্মু অনুভূতির প্রকাশ পছন্দ করে। আমি খুব একটা পছন্দ করি না। হৃদয়ের গভীরে যে আবেগের বসবাস, তা হৃদয়ে তুলে রাখাই শ্রেয়। নয়তো মনে হয়, ঠিকঠাক বুঝি লেখা গেল না, কিংবা লিখলেও কম হয়ে গেল! আরও অনেক কিছু লেখার ছিল যে!