আমি তখন সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় মায়ের ফোন এল
আজ মে মাসের দ্বিতীয় রোববার, মা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে আমরা মাকে নিয়ে লেখা আহ্বান করেছিলাম পাঠকের কাছে। পাঠক লিখেছেন তাঁর বেড়ে ওঠার পেছনে মায়ের অনুপ্রেরণার গল্প।
আমার মা মনীষা মণ্ডল বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করতেন। অফিস ছিল মতিঝিলে, বাসা থেকে বেশ দূরে। মা সকালে বের হতেন, ফিরতেন সেই সন্ধ্যায়। ঢাকা শহরের জ্যামের জন্য বেশির ভাগ দিনই বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যেত। তখন বাসায় কোনো ফোনও ছিল না। অর্থাৎ সারা দিন মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হতো না।
মা যতক্ষণ বাসায় থাকতেন, আমার কাজ ছিল তাঁর পেছন পেছন ঘোরা আর গল্প করা। আমি একদমই চাইতাম না, মা অফিস করুক। এ জন্য মায়ের অফিসে যাওয়ার সময় প্রায়ই তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে কান্নাকাটি করতাম! তারপরও আমাকে সামলে মাকে অফিসে যেতে হতো। কখনো কখনো আমার কান্নাকাটি সামলাতে গিয়ে অফিস বাস মিস করে ফেলতেন মা। তখন আমার আর দিদির রীতিমতো ঈদের আনন্দ হতো!
অফিস থেকে ফেরার সময় প্রতিদিনই আমাদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন মা। অফিসের নানা অনুষ্ঠানে বিশেষ খাবার থাকলে নিজে না খেয়ে আমাদের জন্য আনতেন। কখনো কখনো সেই সুযোগ হতো না। তখন ঠিকই শুক্রবারে আমাদের ভালো-মন্দ রান্না করে খাওয়াতেন। বাবাও একই কাজ করতেন। তাঁদের আদর আর স্নেহেই আমার আর দিদির বেড়ে ওঠা।
মাস্টার্স করতে যখন দেশের বাইরে গেলাম, শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনে বার চারেক ফোন করতেন মা। তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু, নিঃসংকোচে যাকে সব বলতে পারতাম।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে নানা অসুখ বাসা বাঁধে। আমি তখন এমফিল ইন্টারভিউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকালে মা ফোন করলেন। তাঁর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। ঠিকভাবে কথা বলতে পারছিলেন না। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা আমি কি দেশে ফিরব?’ বললেন, ‘আমি ভালো আছি। তুমি ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি নাও।’
এভাবেই সারা জীবন তাঁর অসুখ আমাদের কাছে আড়াল করে রেখেছেন। কিন্তু শেষবার আর সম্ভব হলো না। স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য তাঁকে লাইফ সাপোর্টে যেতে হলো। খবর পেয়ে আমিও দেশে ফিরলাম। মায়ের পায়ে চুমু খেয়ে বললাম, ‘প্লিজ, জলদি সেরে ওঠো। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।’
চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, কোমাতে চলে গেছেন মা। কিন্তু আমার কথায় মা সাড়া দিয়েছিলেন। তখন তাঁর কাঁদার শক্তিও ছিল না। কিন্তু মুখাবয়ব দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি কাঁদছিলেন।
সারা জীবন সব সময় আমাদের আগলে রাখা মানুষটা আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন। ১৮ জুলাই ২০১৯। কিন্তু আমার জীবনে মা আছেন। থাকবেন সব সময়। এখনো কোনো সমস্যায় পড়লে চেষ্টা করি মায়ের মতো করে ভাবতে। চিন্তা করি, মা বেঁচে থাকলে আমাকে কী পরামর্শ দিতেন। আমি বিশ্বাস করি, আমার শেষনিশ্বাস অবধি মা আমার নিশ্বাস হয়ে থাকবেন।
লেখক: দিব্যজ্যোতি দত্ত, পিএইচডি স্কলার, সাংবাদিকতা বিভাগ,
এসআরএম ইউনিভার্সিটি, ভারত।