জেন–জিরা যখন মিলেনিয়ালসের জীবনসঙ্গী, কেমন কাটে তাঁদের দাম্পত্য
সময়ের প্রবাহে এক প্রজন্মের হাত ধরে এগিয়ে আসবে আরেক প্রজন্ম। তৈরি হবে পরিবার, বংশবিস্তার হবে মানুষের, এগিয়ে যাবে মানবসভ্যতা। এগিয়ে যাবে একই প্রজন্মের ভেতর কিংবা ভিন্ন প্রজন্মের দুই মানুষের বিয়ের মধ্য দিয়ে। আজকের আলাপ দুই প্রজন্মের ভেতর বিয়ে নিয়ে।
এখনকার আলোচিত প্রজন্ম জেন–জি। এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সর্বোচ্চ বয়স ২৭ বছর, কাজেই তাঁদের নিজেদের ভেতর বিয়ের পাশাপাশি আগের প্রজন্ম, অর্থাৎ মিলেনিয়ালস বা জেনারেশন ওয়াইদের সঙ্গেও বিয়ে হচ্ছে। জেন–জিদের নিয়ে তো আলোচনা সর্বত্রই। এই প্রজন্ম যখন মিলেনিয়ালসদের জীবনসঙ্গী হচ্ছে, তখন কেমন যাচ্ছে সেই দাম্পত্য জীবন।
এমনি এক মিলেনিয়াল ও জেন-জি দম্পতি সৌমিক রাতুল ও অন্বেষা শ্রেয়া। বছরখানেক আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে। দুজনের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না হলেও ‘জেনারেশন গ্যাপ’ তো আছেই। কাছাকাছি বয়সের হলেও সৌমিকের অভিযোগ—বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে অন্বেষা যেসব শব্দ ব্যবহার করেন, তার অনেক কিছুই সৌমিকের বোধগম্য নয়।
অন্যদিকে অন্বেষা বলছেন, ‘সৌমিক তো পুকি শব্দের মানে জানে না। প্রথমবার শুনে ও ভেবেছিল, খারাপ কিছু হবে। শুধু “লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার” ছাড়া কোনোটাই বোঝে না। কারণ, আমাদের ইংরেজি আর ওদের ইংরেজি আলাদা। বিয়ের পরও ঝগড়া লাগলে ওকে আমি এমন সব শব্দ ব্যবহার করে বকা দিই, যেগুলোর ও মানেই জানে না। হেরে যায় আমার কাছে, হা হা হা হা।’
সত্যিই মুশকিল! সেসব মিলেনিয়াল বোধ হয় বেশ বিপদেই আছেন, যাঁদের জীবনসঙ্গী জেন-জির প্রতিনিধি।
বৈবাহিক অভ্যাসগুলোর ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ, এখন মানুষের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে অনেক। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে জেনারেশন জেডের সদস্যদের মধ্যে। অথচ তাঁদের আগের প্রজন্মের সদস্যরা এ ধরনের চর্চার সঙ্গে অতটা অভ্যস্ত নন। শুধু এটাই নয়, বেড়ে ওঠা, জীবনযাপন, মূল্যবোধ, প্রযুক্তির ব্যবহারসহ অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কাজেই এই দুই প্রজন্মের যখন বিয়ে হয়, সেখানেও বৈচিত্র্য থাকাটাই স্বাভাবিক।
বৈচিত্র্যের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল এক ব্যতিক্রম দম্পতির কথা। এখানে বর বাবুটি জেন-জি (২৭), আর কনে হলেন মিলেনিয়াল (২৯)। তাঁদের বয়সের পার্থক্য মাত্র দুই বছর। তবু সময়ের হিসাবে দুজন দুই প্রজন্মের সদস্য। দুজনই গানের মানুষ। সংগীতের অঙ্গনেই সিনিয়র আপু নীলিমার প্রেমে পড়েছিলেন জেন-জি অতনু। নীলিমার বক্তব্য, ‘অতনু জেন-জি না হলে আমাকে পটাতেই পারত না। ওরা খুব সহজ, কোনো জটিলতা নেই, জীবনটাকে নিয়ে বেশি অঙ্ক কষে না।’
ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ডের সমাজতাত্ত্বিক প্যাট্রিসিয়া হিল কলিনসের কথা থেকে জানা যায়, একটি বিয়ে নানা রকম আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে স্বীকৃতি ও অনুমোদন পায়। তবে আইন একে একটি চুক্তিতে পরিণত করে। এটি একটি ধর্মীয় অঙ্গীকারও বটে। যদিও বেশির ভাগ জেনারেশন জেড বিবাহের জন্য এত সব পরিকল্পনার প্রক্রিয়া শুরু করেননি, তবে তাঁরা বিয়ে করার ব্যাপারে ইতিবাচক মানসিকতা দেখাচ্ছেন এবং জেনারেশন ওয়াইয়ের সদস্য বা মিলেনিয়ালরাও তাঁদের সঙ্গী হচ্ছেন।
চার বছরের বেশি বিবাহিত জীবন পার করেছেন; এমনি আরেক মিলেনিয়াল ও জেন-জি দম্পতি নিবিড় রহমান ও মারিয়া কিবতিয়া।
নিবিড়ের বয়স ৩৪। মারিয়া সবে ২৭-এ পা দিলেন। নিবিড়ের শৈশব কেটেছে নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে কার্টুন দেখে। মারিয়া বড় হয়েছেন অ্যানিমেশন আর কে-পপের আমলে। নিবিড় মনে করেন, সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলে সব সামলে ওঠা যায়। অন্যদিকে মারিয়ার মতে, দায়বদ্ধতা ও সমান-সমান ত্যাগ স্বীকার না থাকলে সম্পর্ক পোক্ত হয় না। দুবেলা ভাত খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন নিবিড়। ফাস্ট ফুড বলতে কফিশপ বা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বার্গার, পিৎজা বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। অথচ মারিয়ার পছন্দের খাবার স্মুদি আর রামেন। অনলাইনে শপিং আর অ্যাপে খাবার অর্ডার করা ছাড়া তাঁর জীবন চলে না। এই যে ভিন্ন সময়ে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা দুজন মানুষের ভেতর বিয়ের সম্পর্ক, এত পার্থক্যের ভেতর সেটা চলছে কীভাবে?
মারিয়া হেসে বলেন, ‘শুরুতে মনে হতো, এ কোথায় ফেঁসে গেলাম। সবকিছু বেশ বিরক্তিকর লাগত। আমার সঙ্গে ওর মিলতই না কিছু। দুজনকেই অনেক কিছু ছাড় দিতে হচ্ছিল। যদিও ও বর হিসেবে খুবই মিষ্টি আর সংবেদনশীল, তবু হতাশ হয়ে যেতাম।’ পাশ থেকে নিবিড় খোঁচা মেরে বলেন, ‘কিন্তু আমাকে ছেড়ে তো থাকতেও পারো না। কোথাও গেলে আবার দুই দিনেই অস্থির হয়ে যাও।’ মারিয়াও খোঁচার জবাব দেন, ‘কী করব বলো। তোমার সঙ্গে ঝগড়া না করে ভালো লাগে না।’
এই সব খুনসুটিতে মারিয়া চিকেন স্টু আর সঙ্গে নিবিড়ের পছন্দের দুধ-চায়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মারিয়া গুনগুনিয়ে চিকেন ম্যারিনেটে ব্যস্ত, নিবিড় লবণ আর মসলা এগিয়ে দিতে দিতে গানের সুরে তাল মেলালেন।
বোঝা গেল, দুই প্রজন্মের এই দুজনের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও নিজেদের বোঝাপড়ায় তাঁরা বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। ভালোবাসারও কমতি নেই।
এদিকে জেন-জি ও মিলেনিয়াল দম্পতি তাহমিনা প্রিয়া ও কাজী রেজোয়ান ইসলাম কাছে জানা গেল, রেজোয়ান সবকিছুতেই বেশ সময় নেন। কিন্তু তাহমিনা যেকোনো সময় খুব দ্রুত সাড়া পেতে চান, নিজেও সাড়া দেন। তাঁরা পরস্পরের পরিবারের সঙ্গে যেভাবে মেশেন, তাতেও পার্থক্য আছে। রেজোয়ান বলেন, ‘মিলেনিয়াল আর জেন-জিরা অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা। আমাদের ভেতর সামাজিকতা বেশি। কিন্তু ওরা বেশ আত্মকেন্দ্রিক। তা ছাড়া অনেক কিছুই যেভাবে আমরা বলি বা করি, ওরা সেভাবে করে না বা বোঝে না। যেমন আমি ছোটদের সঙ্গে একটা বয়স ও সম্মানজনিত সীমারেখা বজায় রেখে চলাফেরা করি। কিন্তু তাহমিনা শিশুদের সঙ্গেও আচরণে কোনো রাখঢাক রাখে না।’
তাহমিনা জানান, রেজোয়ান বন্ধুদের পরিবারের মতোই গুরুত্ব দেন। এটার সঙ্গে তাহমিনার মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ, জেড প্রজন্মের কাছে বন্ধুবান্ধব বেশ একটা ‘ক্যাজুয়াল’ ব্যাপার। অত সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। তবে দুজনই জানালেন যে জেনারেশন গ্যাপ থাকলেও তাঁরা সম্পর্কটাকে সম্মান করেন। পরস্পরের ব্যক্তিসত্তায় হস্তক্ষেপ করেন না।
সমাজবিজ্ঞানী হিল বলেন, বিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করে; যা স্বল্পমেয়াদি সম্পর্কগুলো দিয়ে সহজে পূরণ করা যায় না। বিয়ের গড় বয়সে হেরফের হতে পারে, তবে এটি এখনো বেশির ভাগ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বলা যায়, প্রজন্মের এই ব্যবধান সত্ত্বেও বেশির ভাগ জেন-জি ও মিলেনিয়াল দম্পতি টক-ঝাল-মিষ্টি সংসারে বেশ আছেন।