‘তোমার কাছ থেকে স্বীকৃতি কবে পাব, বাবা’
আমরা দুই বোন। ছোটবেলা থেকেই একটা কথা শুনে বড় হয়েছি—দুই বোন? ভাই নাই! আহা!
আমাদের সমাজে ছেলেসন্তান না থাকা মানে সেই পরিবারকে ভবিষ্যতে এগিয়ে নেওয়ার যেন কেউ–ই নেই। মেয়ে যত শিক্ষিত, যোগ্য বা সফলই হোক না কেন, সংসারের কর্তা হওয়ার যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারে না।
ছেলে না থাকার দুঃখের কথা সেভাবে আমার বাবা কখনো প্রকাশ করেননি। তবে আমাদের ছোট্ট মনে হয়তো গেঁথে গিয়েছিল যে মেয়েরা বাবাদের বুড়ো বয়সের লাঠি হতে পারে না। তাই আমরা কখনো বাবার কাছে কোনো আবদার করতাম না। সেই সঙ্গে ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের সংস্কারজনিত আড়াল। তাই বাবার সঙ্গে একধরনের দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে।
বড় হতে হতে সেই দূরত্ব ব্যক্তিত্বের সংঘাতে রূপ নিল। বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা আমার বাবা, যিনি পরবর্তী সময়ে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান। নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত, চেয়েছিলেন তাঁর মেয়েরা সরকারি চাকরি করবে বা নিদেনপক্ষে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা হবে। কিন্তু না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনার সময়ই আমি সাফ জানিয়ে দিলাম, বিসিএস পরীক্ষা দেব না। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করলাম।
সাংবাদিকের জীবন অন্যদের মতো ছকে বাঁধা নিয়মে চলে না। যেকোনো সময়ই কাজে ডাক পড়তে পারে। এখানে অফিসে যাওয়ার সময়ের যেমন ঠিক নেই, তেমনি ফেরার সময়েরও। সবাই শুক্রবার ছুটি কাটায়, আমি সেদিনও কাজ করি। এমনকি ঈদের দিনও অফিস করছি। প্রথম যেদিন রাত সাড়ে ১১টার পর অফিসের গাড়ি আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়েছিল, বাবা সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে সোজা বাসায় উঠে যান। এরপর প্রায় ছয় মাস আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের জন্য কিছু পেশা ‘নিরাপদ’ ও ‘আদর্শ’ হিসেবে ভাবা হয়। যেমন মেয়েরা চিকিৎসক, শিক্ষক বা ব্যাংকার হবে বা সরকারি চাকরি করবে। নয়টা-পাঁচটা অফিস করে এসে তারা সংসার সামলাবে, পরিবারকে সময় দেবে—এটাই প্রচলিত ধারণা ও চাওয়া। কিন্তু কোনো মেয়ে যদি এই গণ্ডির বাইরে যেতে চায়, তাকে মুখোমুখি হতে হয় সীমাহীন চ্যালেঞ্জের।
বাবা আমার জন্য সর্বোচ্চ ভালোটাই চেয়েছেন, কিন্তু সেই চাওয়া আমার চাওয়ার সঙ্গে মেলেনি। আমার ভালো থাকাটা যে আমার পছন্দের পেশা বেছে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে, সেটা আমিও তাঁর কাছে প্রকাশ করতে পারিনি।
প্রায় ২০ বছরের ক্যারিয়ারে অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। অনেক সম্মান পেয়েছি। তবে বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে না পারার কষ্টটা রয়েই গেছে। সেই সঙ্গে রয়ে গেছে বাবার কাছে স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ, যা একজন সন্তানের জীবনে অনেক বড় কিছু।
বাবার মুখে এখনো শুনতে পারিনি, ‘আমি তোমাকে নিয়ে, তোমার কাজ নিয়ে গর্বিত।’ প্রায়ই আমি ভাবি, এ কথা কেন তিনি বলতে পারলেন না? শুধু আমার বাবাই নন, কেন অনেক বাবাই দ্বিধা আর সংকোচের এই দেয়াল ভাঙতে পারেন না? কেন মেয়ের এগিয়ে যাওয়ায় সমর্থন আর স্বীকৃতির সিলমোহর লাগিয়ে দিয়ে তার পথচলাকে সাবলীল করতে পারেন না অনেক বাবা?
নারীর ক্ষমতায়নের নানা উদ্যোগের কথা শুনি আমরা। কিন্তু এই ক্ষমতায়নের শুরুটা তো হতে হবে পরিবার থেকেই। সমাজকাঠামোর গভীরে প্রোথিত ‘মিসোজিনি’ বা নারী-বিদ্বেষকে উপড়ে ফেলতে ভাঙতে হবে ‘স্টেরিওটাইপ’ বা বাঁধাধরা চিন্তার আগল। মেয়ে দায়বদ্ধতা, পরিবারের হাল ধরতে অক্ষম, পেশাগত সাফল্য তার জন্য জরুরি নয়, সংসার-সন্তানের দায়িত্ব পালনই তার একমাত্র কর্তব্য—এ ধরনের প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব জরুরি এখন। মেয়ের সঙ্গে বাবার নিঃসঙ্কোচ আলাপই তাকে করে তুলবে সাহসী ও দৃঢ়চেতা। তাকে কুণ্ঠিত নয়, উদ্যমী হতে শেখাবে। আক্ষেপ নিয়ে নয়, মাথা উঁচু করে বাঁচার শক্তি জোগাবে।
‘আমি আছি’—বাবার মুখে একটি কথাই মেয়েকে জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগাতে পারে। বাবা-মেয়ের মধ্যে সামাজিক আচার ও সংস্কারগত দূরত্বের এই পর্দা হটাতে কথা হোক।