‘সম্পর্ক’ কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে?

রবার্ট ওয়ালডিঙ্গার একজন মার্কিন মনোবিদ এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একজন খণ্ডকালীন অধ্যাপক। ভাবনা উপস্থাপনের বিখ্যাত মঞ্চ ‘টেড’-এর সবচেয়ে আলোচিত ১০ বক্তৃতার একটি তাঁর দেওয়া। মানুষের জীবনে সম্পর্কের গুরুত্ব নিয়ে তিনি চমৎকার কিছু কথা বলেছেন টেডের মঞ্চেই। পড়ুন নির্বাচিত অংশ। 

রবার্ট ওয়ালডিঙ্গার
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের জীবন বা স্বাস্থ্যে সম্পর্ক কীভাবে প্রভাব ফেলে, কী ধরনের সম্পর্ক আমাদের সুখের অনুভূতি দেয়, সুন্দর সম্পর্কের জন্য কী করা উচিত, এসব বিষয়েই আজ কথা বলব।

হার্ভার্ডের একটি গবেষণায় আমি নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমার জানামতে, একই ব্যক্তিকে অনুসরণ করে এটিই দীর্ঘতম গবেষণা। ১৯৩৮ সাল থেকে আমরা কয়েকজনকে নিয়ে কাজ করছি। ছেলেবেলা থেকে তাঁদের বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া, সন্তান হওয়া, সন্তানদের সন্তান হওয়া, সবই আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। হাজারো জীবনকে কাছ থেকে দেখেছি এবং ৩০ বছর আগে থেকে আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি, সুসম্পর্কের সঙ্গে সুন্দর জীবন কিংবা ভালো থাকার একটা চমকপ্রদ যোগসূত্র আছে। একই সঙ্গে এ-ও দেখেছি, শুধু সুসম্পর্কের কারণেও মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে, মস্তিষ্ক আরও চৌকস হয়।

শুরুতে আমরা এই উপাত্ত পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। ভেবেছিলাম, ‘সম্পর্ক’ কীভাবে আমাদের শরীরের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে? কীভাবে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে? কিন্তু অন্যান্য গবেষণায়ও তখন একই বিষয় উঠে আসতে থাকে। আমরা দেখেছি, যাঁরা হতাশায় কম ভোগেন, তাঁদের ডায়াবেটিস বা হৃদ্‌রোগ হওয়ার আশঙ্কা কম। যাঁরা সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে জানেন, তাঁরা দ্রুত রোগ থেকে সেরে উঠতে পারেন।

বন্ধুত্ব আর ভালো সম্পর্ক মানে শুধু খেয়াল রাখা নয়। বরং তাঁদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। বারবার তাঁদের কাছে ফিরে যাওয়া।
ছবি: প্রথম আলো

একার লড়াই

এখন প্রশ্ন হলো—ভালো থাকা কিংবা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর সম্পর্ক কীভাবে প্রভাব ফেলে?

যে তত্ত্বটি মোটামুটি প্রমাণিত, তা হলো—এর কারণ মানসিক চাপ। মানসিক চাপ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চাপ বাড়া কিংবা কমার ক্ষেত্রে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমার সঙ্গে মন খারাপ করা কিছু একটা ঘটল। মনে মনে সারা দিন ধরে আমি সেই ঘটনার ‘জাবর কাটতে’ থাকলাম। একটা লড়াই করলে আমাদের যেমন হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, ঘাম হয়, একই ঘটনা এ ক্ষেত্রেও ঘটবে। আমার খারাপ লাগতে শুরু করবে।

অথচ ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরই আমার শরীরে স্থিতি ফিরে আসার কথা। শরীর এভাবেই কাজ করে। বাড়ি ফিরে নিশ্চয়ই বাড়ির মানুষের সঙ্গে কথা বলব। কিংবা কাউকে ফোন করব। তখন মন শান্ত হবে। লড়াইটা আড়াল হয়ে যাবে।

কিন্তু আমার যদি বাড়ি ফিরে কথা বলার মতো কেউ না থাকে? ফোন করার কেউ না থাকে? আমাদের গবেষণা বলছে, যাঁরা নিভৃতে বা একা থাকেন, যাঁদের কারও সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই, তাঁরা চাপ সামাল দিতে পারেন না। তাঁরা হয় ‘ফাইট মোড’ নয়তো ‘ফ্লাইট মোড’-এ থাকেন। ‘স্ট্রেস হরমোন’ আমাদের সুখ কেড়ে নেয় এবং শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

দিন শেষে সম্পর্কই বড়

ভালো থাকার জন্য কী ধরনের সম্পর্ক জরুরি? বিষয়টা মজার। আমরা যাদের নিয়ে গবেষণা করছি, তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, মাঝরাতে অসুস্থ বোধ করলে কিংবা ভয় পেলে তুমি কাকে ফোন করবে? অনেকে অনেকের কথা বলেছে। কিন্তু কেউ কেউ কারও কথাই বলতে পারেনি। আমাদের গবেষণা বলে, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে হলে ভরসা করার মতো কিংবা বিপদে আশ্রয় পাওয়ার মতো অন্তত একজন মানুষ থাকা চাই।

আমরা যাঁদের নিয়ে গবেষণা করছি, তাঁদের কারও কারও বয়স যখন ৮০ হয়েছে, তখন প্রশ্ন করেছিলাম, জীবনের কোন বিষয়টি নিয়ে তাঁরা গর্ব বোধ করেন? প্রায় প্রত্যেকেই সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেননি, ‘আমি অনেক টাকা আয় করেছি’ কিংবা ‘বড় পুরস্কার জিতেছি’। তাঁরা বলেছেন, ‘আমি একজন ভালো মেন্টর ছিলাম’, ‘ভালো স্বামী বা স্ত্রী ছিলাম’, ‘আমি সন্তানদের সুস্থভাবে বড় করেছি’। গবেষণায় উঠে এসেছে, জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষ সম্পর্ক থেকেই শক্তি খুঁজে পায়।

একটি পরীক্ষা

কেউ কেউ প্রশ্ন করে, ‘এই উপকারটা পেতে হলে কি আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়তে হবে?’ একেবারেই না। সব ধরনের সম্পর্কই আমাদের ভালো থাকায় সহায়ক হতে পারে। বন্ধু, আত্মীয়, সহকর্মী, পরিচিতজন। স্টারবাকসে যে লোকটা প্রতিদিন সকালে আপনাকে কফি এনে দেয়, দোকানে যে আপনাকে কেনাকাটা করতে সাহায্য করে, প্রতি সপ্তাহে যার সঙ্গে আপনার দেখা হয়; এমনকি অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বললেও আপনি উপকার পেতে পারেন।

গবেষণার জন্য আমরা একটা পরীক্ষা করেছিলাম। কয়েকজন মানুষকে সাবওয়েতে পাঠানো হয়েছিল। এক দলকে বলা হয়েছিল অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। অন্য দলকে বলা হয়েছে তাদের দৈনন্দিন স্বভাব বজায় রাখতে—যেমন চুপচাপ বসে থাকা, মোবাইল টেপা, গান শোনা কিংবা বই পড়া।

দেখা গেছে, যাদের অপরিচিতজনের সঙ্গে কথা বলতে বলা হয়েছে, তারা শুরুতে ভেবেছিল এটা তাদের ভালো লাগবে না। কিন্তু তারাই সাবওয়ে যাত্রায় একটা ভালো সময় কাটিয়েছে। অতএব অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলাও আমাদের ভালো লাগার অনুভূতি দিতে পারে।

সুসম্পর্ক গড়তে কী করব

কীভাবে আমরা মানুষের সঙ্গে যুক্ততা আরও বাড়াব? আমরা বলছি, এর জন্য প্রয়োজন ‘সামাজিক সুস্বাস্থ্য’ (সোশ্যাল ফিটনেস)। শারীরিক সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আমরা ব্যায়ামাগারে যাই, হাঁটি, একটা কিছু করি। বাড়ি ফিরেই কিন্তু বলি না, ‘কাজ শেষ। যথেষ্ট হয়েছে। আর পারব না।’ আমরা জানি, এটা একটা চর্চার অংশ। সামাজিক সুস্বাস্থ্যও একই রকম। বন্ধুত্ব আর ভালো সম্পর্ক মানে শুধু খেয়াল রাখা নয়। বরং তাঁদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া। বারবার তাঁদের কাছে ফিরে যাওয়া।

শনিবার বিকেলে ল্যাপটপে আরও দুই ঘণ্টা মুখ গুঁজে না থেকে একজন বন্ধুকে বলুন, ‘চলো, একটু হেঁটে আসি।’ যে মানুষগুলো আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরও রুটিনের অন্তর্ভুক্ত করুন। হতে পারে সেটা প্রতি শনিবার করে ফোনে কথা বলা কিংবা একসঙ্গে কফি খাওয়া, ব্যায়ামাগারে দেখা করা কিংবা একজন সহকর্মীর সঙ্গে নিয়মিত দুপুরের খাবার খাওয়া।

দীর্ঘদিনের সম্পর্কগুলো একটু চাঙা করুন। বিশেষ করে তাঁদের সঙ্গে, যাঁদের সঙ্গে আপনি থাকেন। শুধু দুজন মিলে কোথাও খেতে বা ঘুরতে যান, হেঁটে আসুন, যদি এটি আপনার রুটিনের অংশ না হয়। এখন আমি আপনার দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাই। এমন কারও কথা ভাবুন, যাঁকে আপনি মিস করেন। আপনাদের হয়তো অনেক দিন যোগাযোগ নেই, হয়তো কথা হয় না। কথা না হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ না থাকলেও চলবে। এখন ফোন বা যে যন্ত্রই আপনি ব্যবহার করেন না কেন, সেটা বের করুন, আর তাঁকে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠান। লিখতে পারেন, ‘আমার তোমার কথা মনে পড়ছিল। ভাবলাম একবার খোঁজ নিই।’ কিংবা আরও ব্যক্তিগত কিছুও লিখতে পারেন। এরপর দেখুন কী হয়।

এই পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য হলো ছোট ছোট উদ্যোগও আমাদের ভালো থাকার ক্ষেত্রে কতখানি ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা বোঝা। এ কাজ আপনি প্রতিদিনই করতে পারেন।